চট্টগ্রামে গায়েবী মামলা, আতংকে নেতাকর্মী

নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সংঘাত-সহিংসতা ততো বাড়ছে ।

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহনের দিনক্ষন যত এগিয়ে আসছে, হামলা, মিথ্যা ও গায়েবী মামলা এবং সংঘাত-সহিংসতা ততো বাড়ছে। নির্বাচনে প্রচারনা চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন বিএনপি- ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। চট্টগ্রামে অধিকাংশ আসনে বিএনপি প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীকের কোন পোস্টার ও ব্যানার লাগাতে পারছেন না। ভয়ে-আতংকে দলের নেতাকর্মীরা প্রার্থীর সঙ্গে গনসংযোগেও আসতে চাচ্ছেন না। প্রার্থীদের সঙ্গে যাকেই দেখা যাচ্ছে, রাতে পুলিশ তাকেই গ্রেপ্তার করছে। মহানগর ও জেলার সব আসনের এক অভীন্ন চিত্র। এমন অভিযোগ বিএনপির প্রায় সব প্রার্থীর।

চট্টগ্রামে নির্বাচনের প্রচারনা চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল অব: অলি আহমদের ছেলে ফারুক সানি। একই ঘটনায় আরও ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবী করেছে এলডিপি। (চন্দনাইশ-আংশিক সাতকানিয়া) আসনে সাতকানিয়ার কেওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আহত অলির পুত্র সানিকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তার বাম হাতের হাড় ভেঙ্গে গেছে। এলডিপির অভিযোগ, উজেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবু ছালেহ শান, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো: আলী, যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন ও উপজেলা ছাত্রলীগের একাংশের সভাপতি শফিউল আলম সোহেলের নেতৃত্বে এলডিপির গনসংযোগস্থলে এই হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় কর্নেল অলি আহমদের ছেলে ছাড়াও কেওচিয়া ইউনিয়ন এলডিপির সভাপতি আবু ছৈয়দ, তার বড় ভাই আব্দুস ছালাম, ছেলে আব্দুল গফুর মো.এনাম, আলী আকবর, আজিজুল প্রমুখ। পরদিন এলডিপি সভাপতি ও ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, সারাদেশে একের পর এক হামলা চালানো হচ্ছে। অতীতে এ ধরনের হামলা বন্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার অহবান করা সত্বেও কোন কাজ হয়নি। তাকে অনুরোধ করবো সন্ত্রাসীদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে ভাল লোকদের উপর আস্থা রাখতে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে’।

তিনি সাতকানিয়ার সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে সাতকানিয়া উপজেলা ও ৬ টি ইউনিয়ন বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আগামীতেও এ আসনে নেতাকর্মীদের উপর হামলার পরিকল্পনা রয়েছে। এ হামলাগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমপি নজরুল ইসলামের ভাই মন্টু ও চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার চৌধুরী।

নগরীর হালিশহরের নয়াবাজার মোড়ে চট্টগ্রাম-১০ আসনে বিএনপির প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের উপস্থিতিতে হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নগরীর কাজির দেউড়ি মোড়ে নিজের বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। তিনি এ হামলার জন্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আফসারুল আমীনের সমর্থকদের দায়ী করেন। নোমান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কোন ভুমিকা না নিলেও আমাদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে!

জানা যায়, নয়াবাজার এলাকায় রাস্তার একপাশে চট্টগ্রাম-১০ আসনের পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের সময় নোমানের বক্তব্য রাখার আগেই সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় হামলা করে। তাদের হাতে পিস্তল, লাঠি, বাঁশ ও তলোয়ার ছিল। এ সময় দলের কর্মীরা নোমানকে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে আশ্রয় নেয় বলে জানা গেছে। এ সময় পাহাড়তলী থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক জসিম উদ্দিন ও বিএনপি নেতা আব্দুস সাত্তারসহ অনেক নেতাকর্মী আহত হন বলে জানায়।

প্রবীন এ রাজনীতিক বলেন, তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের ঘটনার সম্মুখিন হননি। নোমানের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফসারুল আমীনের ভাই এরশাদুল আমীন, যুবলীগ নেতা সুমন দেবনাথ ও স্থানীয় জিয়ার নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে নোমান সংশয় প্রকাশ করে বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বাদ দেন, একজন সাধারন মানুষ ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত নিরাপদে যেতে পারবে কি না সন্দেহ। বর্তমানে যে পরিস্থিতি সেখানে নির্বাচনের কোন পরিবেশ নেই। কেন নির্বাচন করছি, তা পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, আমার দল, জোট কী মনে করে জানি না। কিন্তু নির্বাচন করার কোন সুযোগ আছে বলে আমি নিজে মনে করি না। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। এ অবস্থায় নির্বাচন কিভাবে হবে, বুঝতে পারছি না। বিএনপি প্রার্থীদের প্রচারপত্রও বিলি করতে দেওয়া হচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন,’জনগন ঘুরে দাঁড়াবে, এ বিশ্বাস করি। আমরাও তাদের সাথে থাকব’।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগেরদিন বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ৯০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এক দিনে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনে বিএনপির প্রার্থী কারাবন্দি ডা. শাহাদাত হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনা চালানোর সময় নগর বিএনপির সহ-সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর সবুক্তগীন সিদ্দিকী মক্কীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে ডা. শাহাদাত হোসেনের জন্য ভোট চাইতে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করেন মীর মো: নাছির উদ্দিন, সামসুল আল ও সবুক্তগীন সিদ্দিকীসহ নগরীর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা।গনসংযোগকালে পেছন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ করেন ডা. শাহাদাতের ব্যক্তিগত সহকারী মারুফ চৌধুরী।

আগের দিন শুক্রবার রাত দশটার সময় নগর বিএনপির আরেক সহ-সভাপতি সৈয়দ আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরদিকে চৈতন্যগলির একটি ভবনের ছাদ থেকে যুবদল নেতা টিংকু দাশকে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ৬০ পিস ইয়াবা সহ আটক করা হয় বলে দাবী করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। টিংকু দাশ চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনের বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। একই দিন খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকা থেকে মহানগর স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা আলিম উদ্দিন গুড্ডুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অপরদিকে মহানগর বিএনপির উপ-দপ্তর সম্পাদক মো: ইদ্রিস আলী বলেন,’ নগর বিএনপির দুই সহ-সভাপতি ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ৬০ নেতার্কীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে গনসংযোগকালে এসব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া পটিয়া বিএনপির ১৩ নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন জিরি মালিয়ারা গ্রামের এম.এ হাকিম মেম্বার (৫৫), আব্দুল লতিফ (২৪), দক্ষিণ হুলাইন গ্রামের আবু বক্কর সুজন মেম্বার (৩৫), কৈয়গ্রাম এলাকার কামাল উদ্দিন মেম্বার (৫০), জিরি মল্লপাড়ার আব্দুল মান্নান মেম্বার (৫০), কোলাগাঁও ইউনিয়নের মোহাম্মদনগর গ্রামের হারুন কাকন (৪৮), সেকান্দর হোসেন নয়ন (৩৩), শাখাওয়াত হোসেন খোকন (২৫) হুলাইন গ্রামের মঈন উদ্দিন (৩৮), চরকানাই গ্রামের ফারুক (২০), কোলগাঁও গ্রামের মো: শাহেদ (২২), মো. মানিক (২২) ও মিজান উদ্দিন (২২) শুক্রবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পটিয়া আসনের বিএনপি প্রার্থী এনামুল হক এনামের অভিযোগ, যেসব এলাকায় নেতাকর্মী নিয়ে তিনি গনসংযোগ করেছেন, সেসব এলাকার নেতাকর্মীদের রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যা নির্বাচনের সুষ্ট পরিবেশ নষ্ট করার পায়তারা। তবে পটিয়া পুলিশ বলছে, ওদের ককটেল বিস্ফোরন মামালায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) অসনের ১৮ জন জামায়াত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এদিকে চট্টগ্রাম-৯ আসনের বিএনপি প্রার্থী কারাবন্দি ডা. শাহাদাত হোসেনের বাসায় পুলিশ তল্লাশির নামে পরিবারের সদস্যদের হয়রানী করার অভিযোগ করেছেন তার মা শায়স্তা খানম। গত ১৭ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় নগরীর বাদশা মিয়া সড়কে শাহাদাতের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেন তিনি। শায়স্তা খানম বলেন,’ ১৬ ডিসেম্বর রাত তিনটার দিকে একাধিকবার কলিং বেল দেয়। বাসার কাজের লোক গিয়ে দেখেন বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়ানো। পরে তারা আমাকে এসে বিষয়টি বললে,’ আমি জিজ্ঞেস করি আপনারা কারা? তখন তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বলেন। তিনি বলেন,’ এ সময় পুলিশ সদস্যরা বাসা তল্লাশি করেন। আমি তাদের প্রশ্ন করি,’ শাহাদাত তো কারাগারে তারপরও আপনারা বাসায় কেন? শায়স্তা খানম তার ছেলে ডা. শাহাদাতের প্রচারনায় হামলা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। তবে সিএমপির চকবাজার জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চামকা বলেন,’আমার টিমের মধ্যে কেউ ডা. শাহাদাতের বাসায় যায়নি’।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৪, চট্টগ্রাম-৫, চট্টগ্রাম-৮, চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-১০ ও চট্টগ্রাম-১১ আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নানের মতবিনিময় সভা গত ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম-১০ আসনে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবসে একটি র‌্যালী করতে গিয়েছিলাম। নয়াবাজারে আমার উপর হামলা করা হল। পুলিশের সাহায্য চেয়েও তাৎক্ষনিক পেলাম না। এক ঘন্টা পর এলো পুলিশ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে ফিরলাম। এভাবে হলে তো নির্বাচন করা যাবে না। তাই পুলিশে বড় রদবদল না হলেও অন্তত থানা ভিত্তিক রদবদল করুন।

চট্টগ্রাম-১১ আসনের বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন,নির্বাচনের সময়েও নেতা-কর্মীদের গায়েবী মামলায় গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এই গায়েবী মামলার উদ্ভাবক কে? গায়েবি মামলা কারা দিচ্ছে? এসব বন্ধ করতে হবে। পুলিশের মনে রাখা উচিত, ৩০ তারিখের আগেই সব বিচার শেষ নয়’। হাটহাজারী আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মেজর (অব:) সৈয়দ মো: ইব্রাহীম রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যখন প্রশাসনের কোন কর্তা-ব্যক্তির কাছে যাই, সম্মান পাই। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর কারো কাছে গেলে, সেই সম্মানটুকু দুরের কথা, প্রাপ্য সহযোগিতাও পাচ্ছি না। অতি উৎসাহীরা আমার সমর্থকদের ফোনে হুমকি দিচ্ছে। পোষ্টার নষ্ট করছে। আশা করি, নির্বাচনের আগেই এর প্রতিবাক পাবো। অনুষ্টানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতিয় পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩১ জন প্রার্থী ও তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.