চট্টগ্রাম কাস্টমসে দুর্নীতির মহোৎসব

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতিবাজ চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই চক্রের সদস্যরা (অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী) আমদানীকারকদের নানা কৌশলে হয়রানী করছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে,’এই শুল্ক স্টেশনে পোস্টিং পেয়েই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার নেশায় মেতে উঠেন। আমদানীকারকদের গলা কাটতে তারা চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায়ের নিত্য নতুন কৌশল বের করেন। শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পরও পন্য পুন:নিরীক্ষার নামে চলছে হয়রানী।

এসব বিষয় নিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য তুলে ধরা হলে আমদানীকারকের প্রতিনিধিদের রীতিমতো অপমান-অপদস্ত করা হয়। আইনের নানা ফাঁক-ফোকর বের করে কখনও কখনও আমদানীকারকদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। তাদের আরও অভিযোগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে পন্য চালান ছাড় করে দেয়া হয়। এতে কাস্টমসের এক শ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও গাড়ি বাড়ির মালিক বনে যান। টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত থাকে তাদের দালাল চক্র। কাস্টমসে ফাইল স্বাক্ষর হলেও এই চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে বাসাবাড়ি কিংবা রেষ্টুরেন্টেই হয় ঘুষের লেনদেন। আয়কর বিভাগ কিংবা দুদক থেকে বাঁচতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের স্ত্রী-পুত্র কিংবা স্বজনদের নামেই সম্পদের পাহাড় গড়েন।

কাস্টমসে দুর্নীতির সর্বশেষ উদাহরন হচ্ছে গত ৬ জানুয়ারী চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন ঘুষের ছয় লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন দুদকের হাতে। কাস্টম হাউসের নিচতলায় নিজ কক্ষেই এই কর্মকর্তার আলমারী থেকে ছয় লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন দুদকের হাতে। কাস্টম হাউসের নিচতলায় নিজ কক্ষেই এই কর্মকর্তার আলমারি থেকে ঘুষের ছয় লাখ টাকা উদ্ধার করে দুদকের অভিযান টিম। হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গত ৯ জানুয়ারী কাস্টম হাউসের অপর এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দীর্ঘ তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে এই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার স্ত্রী হালিমা বেগমের নামে পাওয়া গেছে তিন কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার টাকার সম্পদ। ডবলমুরিং থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সামশুল আলম।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতি ও হয়রানী প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড়ের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, ’আমরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে এক পক্ষের দ্বারা দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। আমদানীকারক বা ব্যবসায়ীদের যেমন ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ট্রান্সফারেন্ট হতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে ট্রান্সফারেন্সি থাকলে তবেই দুর্নীতি বন্ধ হবে। দুদকের মহা-পরিচালক (এনফোসমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বলেন,’ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক শ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বেপরোয়া দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে আমাদের কাছে নানা ভাবে অভিযোগ আসছে। তারা নানা কৌশলে আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীদের হয়রানী করে অর্থ আদায় করেন। রাতারাতি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক বনেছেন। এটা সুশাসনের পথে অন্তরায়।

আমরা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ওপর নজরদারী শুরু করেছি। চিহ্নিত কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। এরই মধ্যে এক কাস্টমস কর্মকর্তাকে হাতেনাতে ঘুষের টাকা সহ গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপুর্ন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বনি¤œ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যয় পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। আরও বড় অভিযান পরিচালনা করা হবে। আমদানীকারকদের প্রতিনিধি, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানী ও রফতানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কাস্টম হাউসে দুর্নীতি আরও জেঁকে বসেছে। এ জন্য তারা রয়েছেন উদ্বেগের মধ্যে।

তারা বলছেন, বর্তমান সরকার শিল্প ও বানিজ্যবান্ধব নীতিমালার পথে হাঁটলেও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা হাঁটছেন উল্টোপথে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কেন্দ্রিক ব্যবসা বানিজ্য ও শিল্প ধ্বংস করার চক্রান্তের অংশ হিসেবেই একটি চক্র হয়রানীর পথ বেছে নিয়েছে। ব্যবসায়ী ও ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা প্রনয়ন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এই চক্রটি নানা কৌশলে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পরিস্থিতির কারনে বিভিন্ন সময়ে কাস্টমসে এই অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়ম দুর্নীতি ও হয়রানী বন্ধে দুর্নীতিবাজদের চট্টগ্রাম শুল্ক স্টেশন থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবীতেও বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়। আন্দোলনের কারনে নিতান্ত চাপের মুখে পড়লে অভিযুক্তদের কাউকে বদলি করা হয়। এটিই তাদের শাস্তি। ফলে ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ হয় না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পন্যের ঘোষনা সঠিক থাকা সত্বেও পন্য শনাক্তকরন, এইচএস (হরমোনইজড় সিস্টেম) কোডের মতে একটি টেকনিক্যাল ভুলের কারনে মোংলা, বেনাপাল সহ দেশেরে অন্য কোন স্টেশনে জরিমানা করা হয় না। অথচ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিনিয়ত এইচ এস কোডের ভুলের কারনে জরিমানা করা হয়। অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। যে কারনে জমছে মামলার পাহাড়। আমদানী পন্য এআইআর (অডিট ইনভেস্টিগেশন রিচার্জ) ও শুল্ক গোয়েন্দার মাধ্যমে পন্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর পুন:পরীক্ষার নামেও হয়রানী করা হয়। শুল্ককর পরিশোধের পর পন্য খালাসকালে আনষ্টাফিং বিভাগ পন্য চালান তদারকির পরিবর্তে শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের নামে সময় ও অর্থের শ্রাদ্ধ করে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের অনেকের অভিযোগ, পন্যের এইচএস কোড নির্ধারন, শুল্কায়নযোগ্য মুল্য নির্ধারনসহ আইনগত বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা তাদের আমদানীকারকের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত যুক্তি উত্থাপনের আইনগত অধিকার সংরক্ষন করেন। কিন্তু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত কাস্টমস কর্মকর্তারা ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধিদের কোন যক্তিই গ্রাহ্য করতে চান না।

এমনকি তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি জানাতে গেলে, পিয়ন-দারোয়ান পর্যন্ত নানা কৌশলে আমদানিকারক, তাদের প্রতিনিধি বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অপমান-অপদস্ত করেন। শুল্কায়নযোগ্য মুল্য নির্ধারন করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একচেটিয়া সিন্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। অপ্রয়োজনীয় নথি খোলা হয়। সিদ্ধান্ত প্রদানে বিলম্বের কারনে পন্য চালানের ডেমারেজ বৃদ্ধি হয়। এ ছাড়া রেড-রি রুট ও লক ওপেন এর নামেও চাঁদাবাজি করেন অসাধু কর্মকর্তারা। কাস্টমসের এসি (সহকারী কমিশনার) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পন্য চালানের শুল্কায়ন নিয়ে সংশয় সন্দেহ পোষন করলে মুল্যতালিকায় রেড মার্ক দিয়ে সংশ্লিষ্ট পন্যটির ফাইল আটকে রাখেন। পন্য পুন:শুল্কায়নের পর সেটি ছাড় বা রেড রি রুট করা হয়। অভিযোগ আছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ আদায়ের জন্যই এটি করে থাকেন অসাধু কর্মকর্তারা।

গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কয়েকটি কনটেইনারে পন্য আমদানী করে ঢাকার জারা এন্টারপ্রাইজ। সন্দেহজনক পন্য হওয়ায় খালাস না করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে নির্দেশ দেন শুল্ক, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। চার মাস পর কায়িক পরীক্ষা করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা দেখেন চালানটি খালাস হয়ে গেছে। মহিবুল ইসলাম নামে চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে অ্যাসাইকুড়া ওয়াল্ডের মাধ্যমে চালানটি খালাস হয়। যদিও এ কর্মকর্তা তিন বছর আগেই অবসরে গেছেন। শুধু এ ঘটনাই নয়। গত দুই বছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্টানের ৩ হাজার ৭৭৭ টি চালান অবৈধভাবে খালাস করা হয়েছে বলে এনবিআর এর তদন্তে উঠে এসেছে।

এতে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় এম.আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও চাকলাদার সার্ভিস নামে দুটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্টানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। এ ঘটনার পরপরই কাকরাইল থেকে এম.আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান চাকলাদারকে আটক করে পুলিশে দিয়ে সংস্থাটি। অ্যাসাইকুড়া ওয়াল্ড সিস্টেমের মাধ্যমে পন্য খালাস করতে কাস্টম হাউসের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। একজনের আইডি ও পাসওয়ার্ড অন্যজন ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই্। কোন কর্মকর্তা কাস্টম হাউজ থেকে বদলি হলে বা বিদায় নিলে সংশ্লিষ্ট ইউজার আইডি প্রোগ্রামার কর্তৃক বন্ধ করা হয়। ফলে বিদায় নেয়ার পরও ওই ইউজার আইডি থেকে পন্য খালাসের কোন সুযোগ নেই। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের কাজ করে আসছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কিছু কর্মকতা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.