আওয়ামীলীগের বিভীষণদের থামাতে হবে

0

এস এম মনসুর নাদিম : আওয়ামীলীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অতি জাঁকজমকের সাথে সম্পন্ন হয়ে গেল। ৬৭ বছরের এই প্রাচীন দলটি জন্মের ২২ বছর পর এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে একটি নতুন দেশের জন্ম দিয়ে ক্ষমতায় ছিল মাত্র সাড়ে তিনবছর। এরপর কত মাথার কালো চুল সাদা হল। অবশেষে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামীলীগ আবারো ক্ষমতায় এলো বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে। এ কয়েক বছরে আওয়ামীলীগ মানুষদের আস্থায় নিতে সক্ষম হলেও বর্তমানে আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় শত্রু হল হাইব্রিড আর সুবিধাবাদী নেতাগন। যাদের অবৈধ ব্যাবসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় দলের ভাবমুর্তি ম্লান হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা যখন সরকারী কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করেন তখন তার নৈতিকতার প্রশ্নের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়টা বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। যেখানে স্বার্থ সেখানেই সংঘাত। আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন গুলিও ব্যাক্তিস্বার্থের সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা।

ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখা কমিটি গেল সপ্তাহে তিন বছর মেয়াদ পার করেছে। এই তিন বছরে নগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভুমিকা রাখলেও নিজেদের ঘর গোছাতে পারেনি। মহানগর আওয়ামীলীগের দুই নেতার দুই ব্লকে বিভক্ত সংগঠনটি একটি মাত্র ওয়ার্ড ব্যাতীত আর কোন কলেজ থানার ওয়ার্ড কমিটি করতে পারেনি। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর নগর ছাত্রলীগের ২৯৬ সদস্যের পুর্নাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। মজার ব্যাপার ছিল কমিটি গঠনের পর তিন বছরে মাত্র একবার কার্যনির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছিল। দলীয় সুত্রে জানা গেছে, নগরীতে ২০ টি কলেজ এবং ১৫ টি থানা ও ৪১ টি ওয়ার্ড নগর ছাত্রলীগের ইউনিট কমিটির আওতাভুক্ত। কিন্তু ১৮ নম্বর বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাড়া গত তিন বছরে আর কোন ইউনিট কমিটি গঠন করতে পারেনি সংগঠনটির সভাপতি-সাধারন সম্পাদক। অথচ ছাত্র সংগঠন গুলি থেকেই আগামীদিনের নেতা নির্বাচিত হবে। তাই সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলকেও সক্রিয় করে আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে বিজয়ী করে আনার কাজটি নির্ভার ব্যাক্তিদের হাতে দিয়েছেন শেখ হাসিনা, আর এতে ভরসা করা হয়েছে ছাত্রলীগের এক ঝাঁক সাবেক ছাত্রনেতার ওপর। ১লা নভেম্বর ২০১৬’র দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার শেষ পাতার একটি শিরোনাম ছিল-‘চক বাজারে চাঁদাবাজি ও টমটম বাণিজ্য, টিনুর সাম্রাজ্যে যুবলীগের মহিউদ্দিনের আবির্ভাব’। খবরে প্রকাশ, চকবাজারে মাস খানেক বন্ধ থাকার পর আবারো চালু হয়েছে টমটম বাণিজ্য। আয়ের উৎস ভালো হওয়ার কারনে এখন একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে দুই গ্রুপ। আগে টমটম চলাচলের মুল নিয়ন্ত্রনে ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের কাপাসগোলা এলাকার যুবলীগ নেতা দাবিদার নুর মোস্তফা টিনুর একক আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে তাতে ভাগ বসাতে চাইছে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডিসি রোড এলাকার আরেক কথিত যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন।দুজনই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই নেতার অনুসারী বলে জানা গেছে। দুজনের বিরুদ্ধেই দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় চাঁদাবাজি সহ নানান অভিযোগ রয়েছে। একদা বিএনপি’র মহা সচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুঃখ করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ছাত্রদলের ছেলেরা এখন ঢাকায় এসে রিক্সা চালায়, ফেরি করে। ফখরুল সাহেবকে না কেঁদে অন্তত আল্লাহর দরবারে শোকর গুজার করা উচিৎ ছিল। তাঁর দলের ছেলেরা এবার অন্তত পক্ষে হালাল রুজি করার সৌভাগ্য হয়েছে। ছাত্রদলের এই পরিণতি থেকে ছাত্রলীগের যুবলীগের শিক্ষা নেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। কারন, এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। এইদিনকে টেনে নিবে সেই দিনের কাছে। ২রা নভেম্বর ২০১৬’র দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল-‘যুবলীগের দু গ্রুপে গোলাগুলি’। সংবাদে প্রকাশ, নগরীর আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে যুবলীগের দু গ্রুপের নেতা কর্মীদের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচ টার দিকে অস্ত্র হকি স্টিক ও রামদা হাতে নিয়ে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে একে অপরের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। এতে জামশেদ নামের এক যুবলীগ কর্মী গুরুতর আহত হয়। এখানেও কলোনিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত।
গত ২৬ অক্টোবর ২০১৬’ গনভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন-‘উন্নত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে আমরা বাংলাদেশকে গড়তে চাই। কারন আগামীদিনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো নেতৃত্ব আমাদের গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রলীগের প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ে আদর্শবান নেতা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে। সে জন্য তৈরি হতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের পড়াশোনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, একটু পড়াশোনা করতে হবে। ইতিহাস ভালভাবে পড়তে হবে’। ছাত্রলীগের কর্মীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরনের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন-‘কেউ যেন বিপথে না যায় তা দেখতে হবে। অসৎ পথে চলার পথ আমাদের না। আমাদের চলতে হবে একটা নীতি নিয়ে, আদর্শ নিয়ে’। সত্যিই তো যারা দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে তারা কখনোই বিপথগামী হতে পারেনা। তারা মানুষের বন্ধু, কখনো শত্রু হতে পারেনা। তারা কখনো নিরীহ মানুষের জান-মালের জন্য হুমকি হতে পারেনা। সাবেক ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদকের পদপ্রাপ্তিকে নিজের পরিশ্রমের পুরস্কার এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ স্বীকৃতি আমাকে দিয়েছেন। মতান্তর হতে পারে মনান্তর নয়। তিনি আরও বলেন-শেখ হাসিনার দলে কোনো অনৈক্য বিভেদ কখনো প্রশ্রয় পাবেনা। জনাব ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছেন সেইসব জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে, যারা নৈতিকতার ফ্ল্যাটফরম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে খারাপ আচরণ করেছেন। তিনি বলেছেন-‘আমাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা ভুল করেছেন, তিনি যেই এলাকার সেই এলাকার জনগণের কাছে গিয়ে ক্ষমা চান। যারা আমাদের নির্বাচিত করেছে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে আমাদের কোন লজ্জা নেই। কারো খারাপ আচরণের কাছে আমাদের নেতৃর অর্জনকে জিম্মি করতে পারিনা। এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে ডিসিপ্লিনারি শাস্তি পেতে হবে। এর সঙ্গে কোন আপস নেই’। সুন্দর করে কথা বলা জনাব ওবায়দুল কাদেরের একটা গুন। তিনি তোষামোদগিরি করেননা, স্পষ্ট ভাষায় তোষামোদকারীদের মুহুর্তে বোবা করে দেন। তাঁর স্পষ্ট সাহসী উচ্চারনের জন্য বিরোধী মহলেও তিনি প্রশংসিত।আমার গত লেখায় লিখেছিলাম, বর্তমানে আওয়ামীলীগে বসন্তের কোকিল ও অতিথি পাখিদের দৌরাত্বের কথা।
এতকিছুর পরও কিছু সুসংবাদ যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই তা নয়। শেষপ্রান্তে এসে সেই সুসংবাদটা বলতে চাই। গত ২৬ অক্টোবর ২০১৬’র দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ’ পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল-‘বগি ভিত্তিক রাজনীতিকে বিদায় জানালো চবি ছাত্রলীগ’। এ যেন রাজনীতির মেঘলা আকাশের ফাঁকে এক টুকরা সুর্যের কিরণ ছটা। খবরের সার সংক্ষেপ-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের একমাত্র বাহন শাটল ট্রেন। আর এই শাটল ট্রেনের বগি দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বেঁধেছে বড় ধরনের সংঘর্ষ। এমনকি মৃত্যু আর পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। এই ভুলের সংশোধনে এবার সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি জরুরী বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সকল ধরনের বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষনা করা হয়। সে লক্ষ্যে বগিভিত্তিক রাজনীতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে সকল ধরনের বগির নাম মুছে দিয়েছে টিপু-সুজন পরিষদ। ছাত্রলীগের এই নেতৃবৃন্দের প্রতি অভিনন্দন। রাজনীতিকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে তরুন ও যুবকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর সেই সুস্থধারার রাজনীতি শুরু হোক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে নয়, পরবর্তী প্রজন্মকে একটি উন্নত দেশ উপহার দেয়ার মানসে সুস্থ প্রতিযোগিতা করা হোক। মতান্তর হোক হাজারবার কিন্তু মনান্তর যেন একবারও না হয়। প্রতিযোগিতা আছে থাকবে। তবে তা যেন রক্তারক্তি পর্যন্ত না গড়ায় সেই দায়িত্ব নেতাদের।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.