কিন্তু সব হিসেব নিকেশ পাল্টে গেল গণিতে

0

স্টাফ রিপোর্টারঃ- ভালোই দিয়েছিল সবগুলো পরীক্ষা। এ প্লাস প্রাপ্তিও অনেকটা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সব হিসেব নিকেশ পাল্টে গেল গণিতে। জীবনের যোগ বিয়োগ কিংবা সমীকরণ এভাবে ওলট পালট হয়ে যাবে তা কোনদিন ভাবতেও পারেনি কেউ। গণিত শিক্ষকের ছেলে গণিতে খারাপ করার বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছে জীবনের সব হিসেব। মহসিন কলেজের মেধাবী ছাত্র রাহির আত্মহত্যার পর তার পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনেরা এভাবেই ব্যখ্যা করেছেন বিষয়টিকে। সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের মেধাবী ছাত্র মিনহাজুর রহমান রাহি গতকাল সকালে আত্মহত্যা করে। গতরাতে ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে রাহি নিজ হাতে ডিএ্যাকটিভ করে গেছে তার ফেসবুক একাউন্ট। গণিত প্রথম পত্রের পরীক্ষায় হল পরিদর্শক এক ঘণ্টা খাতা আটকে রাখায় অনেকগুলো অংক করতে পারেনি সে। অতঃপর অংকের সব হিসেব নিকেশের অনেক উর্ধ্বে চলে গেছে রাহি। তার এই অকাল মৃত্যুতে কেবল পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজনের মাঝেই নয় পরিচিত জনদের মাঝেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন কাতালগঞ্জ বাহারউল্ল্যাহ মসজিদের পাশের জনৈক ইব্রাহিমের বাড়ির তৃতীয় তলার বাসিন্দা ফটিকছড়ির বিএমসি কলেজের গণিত শিক্ষক মোহাম্মদ শাহরিয়ার। স্ত্রী, এক ছেলে মিনহাজুর রহমান রাহি এবং দুই কন্যা মুনতাহা এবং মাওয়াকে নিয়ে ছোট্ট সুন্দর সংসার। গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির রোসাঙ্গিরি। কর্মস্থলও ফটিকছড়িতে। স্ত্রীও গৃহিনী। ফটিকছড়িতে বসবাস করলে বিভিন্ন ভাবে সুবিধা হতো। কিন্তু ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে কলেজ শিক্ষক মোহাম্মদ শাহরিয়ার নগরীতে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। প্রায় প্রতিদিনই ফটিকছড়িতে গিয়ে কলেজে শিক্ষকতা করেন। আবার শহরে ফিরে আসেন।

ছেলে মেয়েরাও বেশ মেধাবী। একমাত্র পুত্র মিনহাজুর রহমান রাহি নগরীর চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে পাশ করে। পরবর্তীতে ভর্তি হয় সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। এইচএসসি পরীক্ষায় মহসিন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার হল পড়ে সরকারি মহিলা কলেজে। রাহি ২১৩ নম্বর কক্ষে পরীক্ষা দিচ্ছিল। বিজ্ঞান বিভাগের এই মেধাবী শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে সবগুলো পরীক্ষা বেশ ভালোভাবে দিয়েছে। তার প্রতিটি পরীক্ষা ভালো হয়েছে। গত রোববার ছিল রাহির গণিত প্রথম পত্রের পরীক্ষা। আজ রাহির গণিত দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। ইতোমধ্যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য রাহি কোচিংএ ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু গণিত প্রথম পত্রের পরীক্ষাতেই সব উলট পালট হয়ে যায়। রাহির একাধিক বন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, রাহি গত রোববার গণিত প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিচ্ছিল। সহপাঠী এক বন্ধুর সাথে কথা বলার অপরাধে হল পরিদর্শক রাহির কাছ থেকে খাতা কেড়ে নিয়ে এক ঘণ্টা আটকে রাখে। এতে করে রাহি তার অনেক জানা অংকও কষতে পারেনি।

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে কাতালগঞ্জস্থ বাসায় যায় রাহি। কিন্তু কারো সাথে তেমন কোন কথাবার্তা বলছিল না। কি হয়েছে জানতে চাইলে রাহি তার বাবা এবং মাকে বলে, পরীক্ষা ভালো হয়নি। অনেক অংক করতে পারিনি। এ প্লাস পাবো না। ছেলের কাছে এ কথা শোনার পর বাবা বলেন, আমি গণিতের শিক্ষক। অথচ আমার ছেলে গণিতে খারাপ করেছে। যাক, কি আর করা। দ্বিতীয় পত্রের জন্য ভালভাবে পড়ালেখা করো।’

রাত থেকে রাহি গণিত দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ প্লাস না পাওয়ার আশংকায় রাহি বেশ কান্নাকাটিও করে। তবে রাতে স্বাভাবিকভাবে সে লেখাপড়া করে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাহি নিজের কক্ষে পড়তে বসে। সকালে রাহির বাবা কলেজে চলে যান। তার মা ছোট দুই বোন মুনতাহা এবং মাওয়াকে নিয়ে নিয়ে স্কুলে চলে যান। স্কুল থেকে বাসায় এসে মা নিজের রাহিকে নিজ কক্ষে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখেন।

মায়ের চিৎকারে ভবনের অন্যান্যরা এসে দ্রুত রাহিকে নামায়। তাকে দ্রুত চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা রাহিকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাহির লাশ বিনা ময়নাতদন্তে দাফনের জন্য প্রশাসনের অনুমতি নেয়া হয়। পরবর্তীতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ফটিকছড়ির রোসাংগিরিতে। সেখানে গত রাতে লাশ দাফন করা হয়েছে।

রাহির ঘনিষ্ট আত্মীয় এবং চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপ কলেজ পরিদর্শক মোহাম্মদ আবদুল হালিম পরিবার পরিজন নিয়ে একই ভবনের দোতলায় বসবাস করেন। তিনি গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, বিষয়টি আসলে কি হয়েছিল আমরা জানি না। তবে তার বন্ধুবান্ধব এবং তার সাথে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা সবাই বলছে যে গণিত প্রথম পত্রের পরীক্ষায় হল পরিদর্শক রাহির খাতা এক ঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন। পরীক্ষার হলে খাতা নিয়ে আটকে রাখার কোন নিয়ম নেই উল্লেখ করে আবদুল হালিম বলেন, কোন ছাত্র যদি পরীক্ষায় অসদাচারণ করে তাহলে তাকে বহিষ্কার করার বিধান রয়েছে। যদি রাহি তেমন কিছু করতো তাহলে তাকে বহিষ্কার করা হলে আমরা জানতে পারতাম। তাকে আমরা নজরে রাখতাম। কিন্তু খাতা আটকে রাখার ফলে যে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তা আমরা জানতাম না। যদি এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটে তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

রাহি অত্যন্ত মেধাবী এবং ভদ্র ছেলে ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, কলেজ শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। ইতোমধ্যে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ সবকিছুই কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। রাহির মা এবং বাবা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বলেও তিনি জানান। ছোট দুই বোন কেবল বিলাপ করছে। রাহির মৃত্যু একটি পরিবারের সব স্বপ্ন স্বাদ ধ্বংস করে দিয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.