কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ ও খাদ্য অধিকার আইন চাই

0

সিটি নিউজ,চট্টগ্রাম : বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্জিত হচ্ছে ৭% এর উপরে। বিগত মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রাথমিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা। এ ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি’র ১নং লক্ষ্য ‘দারিদ্র্যের অবসান’ এবং ২নং লক্ষ্য ‘ক্ষুধামুক্তি’সহ সকল লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।

আমাদের খাদ্য নীতি রয়েছে এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তা ত্বরান্বিত করার অন্যতম কৌশল হিসেবে ‘জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল-এনএসএসএস’-এর আলোকে প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাজেট ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আরো নানা কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও দেশের মোট জনসংখ্যার ১২.৯ শতাংশ বা ২ কোটি অতিদরিদ্র এবং দরিদ্র ২ কোটিসহ মোট ৪ কোটি মানুষের অর্ধেকই বেশি কম ও অল্প কম খেতে পায়। বাংলাদেশে এখন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে পায় না বলে অপুষ্টিতে ভুগছে।

রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন ৪৪ শতাংশ নারী। শিশুদের মধ্যে খর্বকায় (কম উচ্চতাসম্পন্ন) ৩৬.১%, কম ওজনসম্পন্ন ৩২.৬% এবং কৃশকায় ১৪.৩%। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স-বিবিএস এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রধানত উত্তরবঙ্গসহ দেশের কয়েকটি জেলায় অতিদরিদ্রসহ দারিদ্র্যের হার এখনও আশংকাজনক (৪২%-৭০%-এর উপরে)। এ পরিস্থিতি দেশে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার-খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রতিষ্ঠার বিষয়কে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে তুলেছে। তাই অবিলম্বে ‘খাদ্য অধিকার আইন’ প্রণীত হলে অতিদরিদ্র ও দরিদ্রদের খাদ্য অধিকার কার্যকর করার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।

পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কার্যকর করার মাধ্যমে অতি দরিদ্রদের অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যায়ক্রমে সকল দরিদ্রে খাদ্য অধিকার নিশ্চিত হবে।

এর ফলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ ও ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ, এসডিজির ১নং লক্ষ্য ‘দারিদ্র্যের অবসান’ এবং ২নং লক্ষ্য ‘ক্ষুধামুক্তি’সহ সকল লক্ষ্য অর্জনে দেশ এগিয়ে যাবে। তাই ক্ষুধামুক্ত সমাজ গঠনে চাই কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ ও খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রামে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন উপলক্ষে গণজমায়েত ও আলোচনা সভায় বিভিন্ন বক্তারা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ-চট্টগ্রাম, আইএসডিই বাংলাাদেশ ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার আয়োজনে ১৬ অক্টোবর নগরীর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে গণজমায়েত, র‌্যালী শেষে আমেরিকান কর্নার চট্টগ্রাম মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন।

সভায় বক্তাগন বলেন বর্তমান সরকার, বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগের কারনে দেশে খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হলেও নিরাপদ খাদ্যের বেলায় মারাত্মক হুমকিতে আছে। অন্যদিকে সরকার হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকায় চাল বিক্রিসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টণীর অনেকগুলি যুগান্তারী উদ্যোগ নিলেও মাঠ পর্যায়ে যথাযথ তদারকির অভাবে এসমস্ত কর্মসুচি গুলি কাঙ্খিত লক্ষ্য পুরণে সমর্থ হচ্ছে না।

বাংলাদেশের সংবিধানে সবার জন্য খাদ্য অধিকারের কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত খাদ্য অধিকার আইন প্রণীত হয়নি। খাদ্য উৎপাদন ও বিপনণে বহুজাতিক কোম্পানী গুলির ক্রমাগত একছত্র আধিপত্য বিস্তার সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আর সে কারনে বিগত বিশ বছরে দেশে খাদ্যের মুল্য বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুনেরও অনেক বেশী, অথচ মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলিতে খাদ্যের মূল্য সেভাবে বাড়েনি।

অন্যদিকে প্রকৃত কৃষক তার উৎপাদিত খাদ্য পণ্যের ন্যায্য মুল্য পায় না, যা মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়ারা এবং খাদ্য ব্যবসবায়ীরাই সিংহভাগ হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে দেশীয় প্রকৃত কৃষক প্রতিবছরই লোকসান গুনছে। সেকারনেই সবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, পুষ্টি নিরাপত্তা, খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদানে রাস্ট্রকে বাধ্য করার বিষয়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে দেশের ৪১ শতাংশ ভুমি হুমকিতে আছে। যা খাদ্য উৎপাদনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

বক্তাগণ সকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন, নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগে মাধ্যমে ভেজালমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ খাদ্য আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ, হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকায় চালবিতরনসহ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টণীর আওতায় গৃহিত কর্মসূচি গুলির যথাযথ মনিটরিং, কৃষিতে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষীদের সরাসরি ভুর্তকির আওতায় আনা, প্রান্তিক কৃষক এবং বর্গাচাষীদের নিয়ে সমবায় গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জোরদার, সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিতকরণ, সকল পর্যায়ে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, নারী কৃষকদের স্বীকৃতি ও ভুমিতে তাদের অধিকার নিশ্চিতকরণ, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পশু পালনকারী, জেলেদের মতো জনগোষ্ঠীর জন্য ভূমি নিরাপত্তা, শিক্ষা, ঋনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার উৎস নিশ্চিতকরণ, খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারকে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ নিশ্চিত করা, কৃষি উৎপাদনে পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে ফসল টিকে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা; ২০২০ সালের মধ্যে বীজ, শস্য, পালন করা, পশুর জিনগত বৈচিত্র বাড়ানোয় কাজ করা, বিশ্ব খাদ্য পণ্যের বাজারে দাম স্থিতিশীল ও ক্রেতার হাতের নাগালের মধ্যে রাখতে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ, কৃষিভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর দাবী জানানো হয়।

ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারন সম্পাদক ও খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ চট্টগ্রামের যুগ্ন আহবায়ক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরীর সঞ্চায়লনায় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ রেয়াজুল হক জসিম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাসির উদ্দীন, সরকারি মহসিন কলেজের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, সিভয়েস২৪ডটকম সম্পাদক এম নাসিরুল হক, সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর আবিদা আজাদ।

আলোচনায় বিশিষ্ঠ নারী নেত্রী ও ইলমার প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা পারু, সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কবি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ক্যাব চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা সভাপতি আলহাজ্ব আবদুল মান্নান, সবুজের যাত্রার নির্বাহী পরিচালক সায়েরা বেগম, চট্টগ্রাম জেলা স্কাউটস এর সাবেক সম্পাদক অধ্যাপক শাহনেওয়াজ, ক্যাব চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারন সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, যুগ্ন সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, শৈলীর প্রধান নির্বাহী নাসির উদ্দীন অনিক, আইডিএফ এর সুর্দশন বড়ুয়া, সংসপ্তকের অগ্রদুদ বড়ুয়া, আস্থাপন সোসাইটির নিশি আকতার, ক্যাব সদরঘাটের সভাপতি শাহীন চৌধুরী, সুফিয়া কামাল ফেলো জান্নাতুল ফেরদৌস, সুফিয়া কামাল ফেলো রুবি খান, ক্যাব পাঁচলাইশের সেলিম জাহাঙ্গীর, জেলা সামাজিক উদ্যোক্তা পরিষদের যুগ্ন সম্পাদক মুহাম্মদ জানে আলম, সেলিম সাজ্জাত, হারুন গফুর ভুইয়া, মোনয়েম বাপ্পী, ক্যাব বন্দরের আলমগীর বাদসা, ক্যাব যুব গ্রুপের সভাপতি চৌধুরী কে এনএম রিয়াদ, সম্পাদক নোমান উল্লাহ বাহার, সম্মিলিত সামাজিক সংগঠনের মোহাম্মদ এহসান প্রমুখ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.