খাগড়াছড়ির রামগড়ে মাদক এখন হোম সার্ভিস !

0

শ্যামল রুদ্র,খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির রামগড় সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলসহ বির্স্তীণ এলাকায় মাদকের ব্যবহার ও পাচার বৃদ্ধি পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিশোর-তরুন থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ এখন এ অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ-বিজিবির অভিযানের মধ্যেই চোরাকারবারিরা তাদের অশুভ কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে বলে শুনা যাচ্ছে। এ অপতৎপরতা বন্ধে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পুলিশের সত্যিকারের সক্রিয়তা চেয়েছেন এলাকাবাসী।

এদিকে, সোমবার (১৩,আগষ্ট ) রামগড় উপজেলা মাসিক আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক সভায়ও বিষয়টি ওঠে আসে। সভায় রামগড় পৌরসভার প্যানেল মেয়র- ১ আহসান উল্যাহ অভিযোগ করে বলেন, পৌর এলাকায় মাদক এখন হোম সার্ভিসে পাওয়া যায়। কেউ অর্ডার দিলে ঘরে বসেই পাবেন। হালের ইন্টারনেট ভিত্তিক জুয়া “সিলন তীর”র আগ্রাসী থাবায় উপজেলার যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। তিনি অভিযোগ করেন, রামগড় থানা “সিলন তীর”র এজেন্ট থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেন।

সম্প্রতি থানা পুলিশ বল্টুরাম এলাকার মদ ও জুয়ার আসর থেকে ৭জনকে গ্রেপ্তার করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) তালাত মাহমুদ অভিযোগ অস্বীকার করে সভায় জানান, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে পুলিশ নিরলস ভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, অপরাধীরা ধরা পড়লে কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তির তৎপরতা বেড়ে যায়। তাঁদের টেলিফোনের কারণে সঠিক ভাবে কাজ করা যায় না। রামগড় ৪৩, বিজিবি’র (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সুবেদার নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় মাদক, বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী কিংবা গরু আটক হলে কতিপয় ব্যক্তি টেলিফোনে তদবির করে। কিন্তু বিজিবি সীমান্তে মাদক ও চোরাচালান দমনে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ।

এদিকে গত ২৯,আগষ্ট রামগড়ের শীর্ষ মাদকব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বাদশা কে (২৩) ইয়াবা বড়িসহ রামগড় থানা পুলিশ আটক করেছে। এর আগে ২২আগষ্ট রামগড় বিজিবি বাংলা পাড়া এলাকা থেকে বোতন ড্রাইভার (৩৪), মো. আল আমীন (২২) ও আলী আকবর (২২) নামের তিন মাদক কারবারিকে ইয়াবা বড়ি সহ আটক করে। ১৬ আগষ্ট বিজিবি হোসেনের খিল এলাকা থেকে ইয়াবা বড়িসহ আটক করে মো. জাফর আলী (২৮) নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে। ১৫ আগষ্ট আবার বাংলাবাজার এলাকা থেকে ইয়াবা বড়িসহ আলাউদ্দিন হোসেন (২০) ও শহিদুল ইসলাম (৩৫) নামে দুই মাদক ব্যবসায়ী আটক হয় বিজিবির হাতে। ৭আগষ্ট চার নারী মাদক কারবারি মদসহ আটক হয় রামগড় থানা পুলিশের হাতে। এরা হলো, মুন্নি আক্তার (৪০), শামসুন্নাহার পারভীন(৩৭), মায়াবী মারমা (৪০) এবং মাসাং মারমা (৩৫)। ৬ আগষ্ট চা বাগান এলাকায় বিজিবি’র ধাওয়া খেয়ে এক কেজি গাঁজা ফেলে পালিয়ে যায় পাচারকারী। এভাবে একের পর এক মাদককারবারি ধরা পড়লেও এদের অপতৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না।

রামগড় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল কাদের বলেন, প্রতিটি মাসিক বৈঠকে মাদক প্রতিরোধে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কথা বলা হয় কিন্তু কাজ হচ্ছে বলে তো মনে হয় না। লোকজন বলাবলি করছে মাদকের স্বর্গরাজ্য এখন রামগড়। দিন দিন যেন মাদক বেড়েই চলছে এলাকায়। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় নারীরাও মাদক পাচার ও মাদক গ্রহনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে শুনা যায়।

অধ্যক্ষ ফারুকুর রহমান মাদক বিরোধী উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,“জীবনকে ভালোবাসুন মাদক থেকে দূরে থাকুন” “ মাদক নয় Ñ মৃত্যু নয়, মাদকমুক্ত জীবন চাই” “এসো নেশা ছেড়ে কলম ধরি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি” ইত্যাদি মাদক বিরোধী প্রচারনা শ্লোগান ” মাদকাসক্তদের কর্ণকুহরে কিছুতেই পৌঁছুনো যাচ্ছে না। তথ্য অফিসের উদ্যোগে গ্রাম-শহর সর্বত্রই মাদকবিরোধী চালানোর কথা উল্লেখ করে তথ্য কর্মকর্তা বিশ্বনাথ মজুমদার বলেন, তরুনরা কুসঙ্গে মিশে না বুঝে ভ্রান্ত ধারনা থেকে কিংবা অসৎ লোকের প্ররোচনায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যক্তি ও পারিবারিক সচেতনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা জরুরী।

সরেজমিন ঘুরে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,রামগড় সীমান্তের বিভিন্ন হাটবাজারে ইয়াবা,ফেনসিডিল,হেরোইন,গাঁজা,চোলাইমদসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য অবাধে বিক্রি হয়। ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা ফেনসিডিল,ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ,গাঁজা এবং দেশি চোলাইমদ এখানে খুবই সহজলভ্য। রামগড় ও এর আশপাশের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য পাওয়া যায়। যদিও বিজিবি-পুলিশ বিভিন্ন সময় মাদকাসক্তদের ডেরায় হানা দিয়ে তাদের পাকরাও করছে।

রামগড় ৪৩ বিজিবি অধিনায়ক লে.কর্নেল মো. নুরুজ্জামান,জি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে বিজিবি জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও একশ্রেনীর বখাটে এসব অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে, তবে এ বিষয়ে বিজিবি খুবই সজাগ। মাদকসেবী সন্দেহভাজন তরুনদের কর্মকান্ডের ওপর তীক্ষè নজর রাখা হয়েছে। মাদক পাচার ও সেবনের খবর পেলেই তাদের আটক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া আছে বলে তিনি জানান।

সূত্র জানায়,রামগড়ের মহামুনি, সোনাইপুল,দারোগাপাড়া,ফেনীরকূল,আনন্দপাড়া,আবাসিকএলাকা, পর্যটন এলাকা,জগন্নাথপাড়া,বল্টুরাম,গর্জনতলী,মাষ্টারপাড়া,চৌধুরিপাড়া,তৈচালা,লালছড়ি,লামকুপাড়া,খাগড়াবিল,গার্ডপাড়া,বাংলাবাজার, বাগানবাজার,বাঘমারা,বড়বিল,চিকনছড়া,হেয়াকো,বালুটিলা,আমতলা,কয়লামুখ,জালিয়া পাড়া,নাকাপা প্রভৃতি এলাকায় মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। কমিউনিটি পুলিশের সাবেক সাধারন সম্পাদক মো.আবদুল জলিল বলেন,এসব এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদকসেবীদের বেশ কয়েকবার বিতারিত করেছি। কিন্তু কয়েকদিন পরই তারা এলাকায় ফিরে আসে। এ জন্য দরকার স্থানীয় লোকজনের সচেতনতা। এদের প্রতিরোধে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়,রামগড় এলাকার অভিজাত পরিবারের সন্তানেরাও মাদকসেবীদের সাহচর্যে এসে মারাত্বকভাবে নেশার জগতে ঢুকে পড়ছেন। পারিবারিক অশান্তির কারণে হতাশায় ভোগে শেষ পর্যন্ততাঁরা বিপদগামী হয়ে পড়েন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক হতাশা গ্রস্থ অভিভাবকেরা জানান, মাদকাসক্ত অবাধ্য সন্তানদের বাগে আনতে বন্ধুবান্ধব ও পারিবারের পক্ষে নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু বহু চেষ্টার পরও তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যাচ্ছে না।

রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারেক মো. হান্নান বলেন, পুলিশের পক্ষে একা মাদক বিরোধী অভিযানে সফলতা পাওয়া কঠিন। এ কাজে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনদের আন্তরিক ভাবে অংশগ্রহন খুবই জরুরী। কেননা মাদক সেবী ও পাচারের সঙ্গে স্থানীয়রা জড়িত থাকতে পারে। তবে এলাকায় মাদক পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে এখন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে বলে জানান।

সম্প্রতি খবর পেয়ে এই প্রতিনিধি ও অন্য একজন সংবাদকর্মী রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, পেছনের সীমানা প্রাচীরের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা অসংখ্য ফেনসিডিলের খালি বোতল পড়ে রয়েছে। মাদকাসক্তরা নেশার সিরাপ খেয়ে খালি বোতল ছুড়ে ফেলে বিদ্যালয়ের ভেতর। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়ের সামনের খোলা অংশে স্থাপিত শহীদ মিনার এলাকায় মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহড়ী মো.আবু তাহের বাধা দিতে গিয়ে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার হেনস্থার শিকার হয়েছেন। দফতরি মো.আবু বক্কর বলেন,বখাটেদের উৎপাত চরম পর্যায়ে,তারা কোন বারণ শুনতে চায় না। বিদ্যালয়ের পুরো এলাকায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণের অনুরোধ জানান তাঁরা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.