চকরিয়ার চাষীরা সবজি চাষে স্বাবলম্বি

0

বশির আল মামুন,সিটি নিউজ : পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার বৃহৎ উপজেলা হচ্ছে চকরিয়া। প্রায় সাড়ে তিন লাখ জনবসতির এ এলাকার অধিকাংশই কৃষক। চির সবুজ এ উপজেলায় রয়েছে একটি পৌরসভাসহ ১৮টি ইউনিয়ন। এ সব ইউনিয়নের মধ্যদিয়েই আঁকাবাঁকা পথে চলে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উৎপত্তি হওয়া আবহমান মাতামহুরী নদী।

নদীর উজানের দিকে এ উপজেলার বমু ইউনিয়ন আর ভাটিতে রয়েছে বদরখালী ইউনিয়ন। নদী তার চলার পথে বর্ষায় তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর পরিমান পলি জমিয়ে দেয়। এতে নদীর দুতীরে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় চর। মাতামহুরীর এসব চরে সবজি চাষ করে এখন ভাগ্যেও পরিবর্তণ ঘটেছে অনেক চাষীর।

সরজমিনে পলি জমার ফলে জেগে উঠা নদীর পাড়ের মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এসব উর্বর জমির অধিকাংশে তামাক চাষ হতো। সেই তামাক চাষিরা এ বছর বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় সবজির আবাদ।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় এসব জমিতে ক্রমান্বয়ে আলু, বেগুন, টমেটো, মরিচ, ডেঁড়স, ফুলকপি, সরিষা, ভুট্টা, চীনাবাদামসহ বিভিন্ন রকমের রবিশস্যের চাষ করে তামাকের বিকল্প ফসল হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে। তেমনি একজন সফল চাষী হলেন সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের একজন মো. জাহাঙ্গীর। বর্তমানে এলাকায় তিনি সফল সবজি চাষি হিসেবেই পরিচিত। তার সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের গ্রাম ও পাশের গ্রামের মোহাম্মাদ পুতু ও ফজলের মতো অনেকেই সবজি চাষ করে লাভবান হয়েছেন।

কৃষক জাহাঙ্গীর বলেন আবাদযোগ্য এসব জমির পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা ও বিভিন্ন স্থানে পতিত জমি পড়ে থাকতো। বর্তমানে বাড়ির আঙিনাসহ প্রায় ২.৫ কানি পতিত জমিতে উন্নত জাতের সবজি চাষ করেন তিনি। এসব রবিশস্য খুচরা বিক্রির পাশাপাশি পাইকাররাও তার জমি থেকে কিনে নিয়ে যায়। সবজি বিক্রি করে এ বছর তিনি প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করেন।

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বিভিন্ন সবজির বীজ পেয়ে বাড়ির আঙিনায় লাউ ও শিমের চাষ করেছি। পতিত জমিতে বাঁধাকপি, ফুলকপি ও বরবটি লাগিয়েছি। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি।’
জাহাঙ্গীরের মতো উচ্চ ফলনশীল সবজির বীজ পেয়ে গরিব চাষিরা বাড়ির আঙিনায় ও বিভিন্ন পতিত জায়গায় মৌসুমী সবজি চাষ করে যেমন লাভের মুখ দেখছেন, ঠিক তেমনি পরিবারের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হচ্ছে।

চকরিয়া পৌর এলাকার ২ নং ওয়ার্ড চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষক কামাল উদ্দিন বলেন গক বছরের মত এবারও মাতামুহুরী নদীর আমান চরে তিন কানি জমিতে টমেটোর চাষ করেছেন। বাম্পার ফলন হওয়ায় মহাখুশি চাষি কামাল।

কামাল উদ্দিন বলেন, শুরু থেকে ক্ষেতে উৎপাদিত টমেটো প্রতি কেজি ১৫ টাকার বেশি বিক্রি করে আসছেন। এই পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করেছেন। আর চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার টাকা।

কামাল উদ্দিনের মতো মাতামুহুরী নদীর তীরে শীতকালীন সবজির চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন হালকাকারার আবদুল করিম (৫২), বরইতলীর মইনুল আলম (৫৫), বিএম চর ইউনিয়নের চাষি মনছুর আলমসহ (৩৪) অনেকে।

চাষিরা জানান, উপজেলার বমু, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, পৌর সভার হালকাকারা, আমানচর, কৈয়ারবিল, খীলসাদক, পূর্ববড়ভেওলা, বরইতলী, শাহারবিল ইউনিয়নের মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের উর্বর জমিতে এখন সবুজের সমারোহ। কক্সবাজারের ছোট-বড় দুই শতাধিক হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে এখানকার উৎপাদিত ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বরবটি, হাইব্রিড মরিচ, শিম, ঝাড় শিম, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, লালশাক, পুঁইশাক, মুলা, ঢ্যাঁড়স, আলু, মিষ্টিআলু, ভুট্টা, চিনা বাদাম, ধনিয়া, পেঁয়াজ ও রসুন। বিশেষ করে মাতামুহুরীর চরে এবার টমেটোর বাম্পার ফলন হয়েছে। এই টমেটো জেলার চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে মাতামুহুরীর তীরে আট হাজার ৮৯৮ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৮১৯ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে ফুলকপি, এক হাজার ১৫০ হেক্টরে টমেটো, এক হাজার ৫৪০ হেক্টরে হাইব্রিড মরিচ, ৬২০ হেক্টরে মুলা, ৮০০ হেক্টরে আলু, ৬২০ হেক্টরে বেগুন ও ৪২০ হেক্টরে ঝাড় শিমের চাষ হয়েছে। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে অন্যান্য সবজির চাষও হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় শীতকালীন সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। দামও বেশি পাওয়ায় ২০ হাজারের বেশি চাষি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। অনেকে বিষাক্ত তামাক চাষ বাদ দিয়ে সবজি চাষে এগিয়ে আসছেন।

জানা যায়, একসময় দক্ষিণ কাকারা গ্রামে বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাকের চাষ করতেন শিক্ষিত বেকার রেজাউল করিম। দুই বছর ধরে তিনি তামাক বাদ দিয়ে চাষ শুরু করেন নতুন জাতের ফল স্ট্রবেরির। এতে তিনি সফলও হয়েছেন।

রেজাউল করিম বলেন, ই”ছাশক্তি আর পরিশ্রম করলে যে কেউ চাষাবাদ করেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। ই”ছাশক্তির ওপর ভর করে তামাক বাদ দিয়ে স্ট্রবেরি চাষ করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছেন।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাইদি বলেন, মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের ২০ হাজার একরের বেশি উর্বর জমিতে প্রায় ২০ হাজার চাষি নানা জাতের শাকসবজি চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন। তিনি বলেন বর্তমানে মাতামুহুরী নদীতে দুটি রাবারড্যাম রয়েছে। বিভিন্ন অংশে কয়েকটি রাবারড্যাম নির্মাণ করে আরও ২০ হাজার একর জমি চাষাবাদের আওতায় আনা যাবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.