চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভোগে পথচলা
জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটিনিউজ :: চট্টগ্রামে একদিকে ওয়াসার প্রকল্প অপরদিকে ফ্লাইওভার প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি সব মিলিয়ে প্রতিদিন অন্তহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন সড়কে চলাচলকারী কয়েক লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক টানা বর্ষণে রাস্তার অধিকাংশ স্থানে পিচ উঠে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বিপর্জ্জনক এ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে ঝুঁকি নিয়ে। প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। সড়কে চলতে দিয়ে উল্টে যাচ্ছে পন্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান। মাঝপথে বিকল হচ্ছে তিন চাকার যান। এ অবস্থা মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত সড়কের।
প্রতিদিন লেগে থাকে অসহনীয় যানজট। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, পুরাতন চান্দগাঁও থানা, সিন্ডবি রাস্তার মাথা এলাকাকয় কয়েক ঘন্টা আটকে থাকে গাড়ি। বেহাল সড়কের কারনে সৃষ্ট নিরসনেও উদ্যোগ নেই ট্রাফিক পুলিশের। উপরন্তু মোড়ে মোড়ে পন্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করতেও দেখা গেছে। আবার জলাবদ্ধতার কারনে রাস্তায় পানি জমে বিটুমিন উঠে নষ্ট হয়ে গেছে নগরীর অধিকাংশ সড়ক। জলমগ্ন সড়কে ভারী যানবাহন চলায় নগরীর অনেক সড়রের মাঝখানে পুকুর সৃষ্টি হয়েছে।
নগরীর ৩৩০ কিলোমিটার রাস্তার অধিকাংশ এ রকম। নগরীর পোর্ট কানেকটিং রোড়ের সরাইপাড়া, নয়াবাজার থেকে ফইল্যাতলি বাজার পর্যন্ত সড়কের অবস্থা খুব করুন। সড়কের উপর গর্তের মাঝখানে খুঁটি বসানো হয়েছে। যাতে পানির মধ্যে গাড়ি চালকরা ওদিকে না যায়। নগরীর পোর্ট কানেকটিং রোড়, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড়ের শান্তিবাগ থেকে বেপারী পাড়া পর্যন্ত এবং মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত রোড়টির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ ছাড়া ষোলশহর দুই নম্বর গেইট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত, ষ্ট্যান্ড রোড় সহ প্রায় সব রোড়েই গর্ত রয়েছে।
এসব সড়কে গাড়ি চলে হেলেদুলে। এভাবে সড়কগুলো ভাঙ্গার কারন জানতে চাইলে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আফতাব হোসেন খান বলেন,’চট্টগ্রামের সড়কগুলো বিটুমিনের তৈরী। এই বিটুমিনের সড়কে পানি জমলেই তা নষ্ট হয়ে যাবে। জলমগ্ন এই শহরের রাস্তাঘাট নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারন হচ্ছে জলাবদ্ধতা। আর এই জলাবদ্ধতার সময় যদি রাস্তার উপর দিয়ে কোন ভারী যানবাহন চলাচল করে তাহলে আরও দ্রুত ভেঙ্গে যাবে রাস্তাঘাট।
তার মতে, শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার সময়টুকু পাবে বিটুমিনের রাস্তা। এর বেশি সময় পানি থাকলেই তা নষ্ট হয়ে যাবে। এ জন্য রাস্তা পর্যাপ্ত ঢালু করার পাশাপাশি পানি নিস্কাশনের জন্য নালা নির্মান করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী ১১০০ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা রাস্তা রয়েছে।
এর মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩০ কিলোমিটার রাস্তা এবারের বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পোর্ট কানেকটিং রোড়, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড়, ডিটি রোড়, ষ্ট্রান্ড রোড়, সিডিএ এভিনিও রোড়, আরাকান রোড়, হাটহাজারী রোড়, বায়েজিত বোস্তামী রোড়, কাপাসঘোলা রোড়, খাজা রোড়, মিয়াখান রোড় ও হালিশহর রোড়।
মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেছেন, ’আমাদের সড়কগুলো বিটুমিনের সড়ক। আর বিটুমিনের সড়কে পানি জমলে তা নষ্ট হয়ে যায় এবং মহানগরীর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য আগামীতে অনেকগুলো সড়ক (আগ্রাবাদ এক্সেস রোড়, পোর্ট কানেক্টিং রোড়) উঁচু করার পাশাপাশি রাস্তার পাশে পর্যাপ্ত নালা নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছি।
এতে রাস্তার উপর পানি জমবে না এবং রাস্তাগুলো রক্ষা পাবে। মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন মোড়ের দুরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। হাটহাজারী সড়কের এ পথ পার পার হতে নরক যন্ত্রনায় ভুগছেন হাজারো মানুষ। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সড়কের এ অংশটি হয়ে উঠেছে আরও ভয়ঙ্কর। চলছে ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্পের নতুন পাইপ লাইন স্থাপনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি। রাস্তায় নামতেই ইচ্ছে হয়না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন লালার হাটের ঔষুধের দোকানদার মো: শফি। অভিযোগ রয়েছে, জনদুর্ভোগের গুরুত্ব নেই সেব সংস্থার।
সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায় নগরীর প্রায় সব সড়কে জনদুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। ঈদের আগে ফ্লাইওভারের একপাশে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে দুর্ভোগ কিছুটা কমে আসে। কিন্তু কোন ধরনের ঘোষনা ছাড়াই গত সপ্তাহে ফ্লাইওভারে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সময়ে ফ্লাইওয়ারের নিচের সড়কে চলছে ওয়াসার খোঁড়াখুড়ি। এতে দুর্ভোগের মাত্রা আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে রাত ১১টার মধ্যে নগরীর সিডিএ এভিনিউতে ব্যারিকেট দিয়ে পাইপলাইনের কাজ করতে গিয়ে।
মদুনাঘাট ও কর্নফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ এর আওতায় নগরীতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসাচ্ছে ওয়াসা। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও অপরিকল্পিতভাবে পাইপলাইনের কাজ করতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলেন, চট্টগ্রামের সেবাসংস্থা সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিদ্যুতের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই।
সিটি কর্পোরেশন সড়ক সংস্কার করেছে, এরপর সড়কের ডান পাশ কেটেছে পিডিবি তার ক্যাবল বসানোর জন্য। এবার সড়কের বাম পাশ কাটতে শুরু করে চট্টগ্রাম ওয়াস। এ দুই সংস্থার কাটাকাটির পর সড়কের মাঝখানে যান চলাচলের অবস্থা আর নেই। এর পর আছে ব্যক্তি পর্যায়ে রাস্তা কাটার অনুমতি।
ওয়াসার সংযোগ ও গ্যাস সংযোগের কারনে কাটছে সড়ক। এতে করে জনগনের দুর্ভোগ যেমন বাড়ছে তেমনি অপচয় হচ্ছে সরকারের টাকা। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড়ের বেপারী পাড়া থেকে শান্তিবাগ পর্যন্ত অংশে প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। বর্ষনের সময় তো জলাবদ্ধতা বাড়ে বহুগুন। এই কোমরসমান জলাবদ্ধতার মধ্যেই চলে ভারী কভার্ড ভ্যান ও ট্রাকগুলো। ফলে এ সড়কের মাঝখানে অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে সড়কটি।
এমন নাজুক অবস্থায় শান্তিবাগ ও জেলা পুলিশ লাইনের বিপরীত পাশের রাস্তার অর্ধেকাংশজুড়ে বিশাল খাল খনন করে দীর্ঘ এক মাস ফেলে রেখেছে ওয়াসা। ঠিকাদারের সামান্য বিচার বিবেচনাবুদ্ধিও কি নেই, এমনিতেই এক্সেস রোড়ের অবস্থা খারাপ। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন গর্ত খুড়ে রাখাটা জনদুর্ভোগ চরমে তুলেছে।
নগরীর বিমানবন্দর সড়ক, ষ্ট্যান্ড রোড়, ভিআইপি সড়ক (সিমেন্ট ক্রসিং থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত) আলকরন রোড়, সিডিএ এভিনিউ, আরাকান সড়ক ও কদমতলী ফ্লাইভারের উঠা-নামার মুখে সড়ক ভেঙ্গে গেছে। তবে সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএর নির্ভরযোগ্য সুত্র মতে, নগরীর ভাঙ্গা সড়কগুলো সারিয়ে তুলতে বর্ষার পরপরই একযোগে কাজ শুরু হবে।
জনসাধারনের মতে, সড়ক যতটা যানবাহনের চাপে নষ্ট হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি নষ্ট হচ্ছে জলাবদ্ধতায়। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে না পারলে সড়ক মেরামতের সুফল বেশিদিন পাওয়া যাবে না। তাদের মতে, জলাদ্ধতামুক্ত নগরী গড়তে হলে সবার আগে প্রয়োজন নগরীর প্রধান খালগুলো থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও খাল খনন, সড়কের পাশের নালাগুলো প্রসস্তকরন এবং সর্বোপরি কর্নফুলী নদী খনন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, কর্নফুলী নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারন ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে গেছে। যে কারনে সামান্য বৃষ্টি ও জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে নগরী।