চট্টগ্রামে নাকাল নগরবাসী এবং সরকারীদলের ত্রাস

0

জুবায়ের সিদ্দিকী  :    চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। চট্টগ্রামের এমন অনেক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা রাজধানী ঢাকাতেও নেই। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানীর মর্যাদা বা সুযোগ সুবিধা চট্টগ্রামকে দেয়া হয়নি। নানা কারনে চট্টগ্রাম আজ অবহেলিত। অবহেলার জন্য প্রধানত দায়ী সরকার। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় এমপি ও মন্ত্রীরাও কম দায়ী নয়। কারন তারা সরকারের কাছাকাছি থেকেও চট্টগ্রামের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন এ কথাও স্বীকার করতে হবে। তবে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, দলের অপরিনামদর্শী নেতা ও কর্মীর আচরণ দলের জন্য চরম ক্ষতি ডেকে আনে। এমনও দেখা গেছে, একজন নেতা অথবা সংসদ সদস্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলকে ডুবতে হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দলকেই নেতাকর্মীদের অপকর্মের বোঝা বহন করে মুলধারা থেকে সরে আসতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের জন্য বিষয়টি অবশ্যই স্পর্শকাতর। কারন ক্ষমতাসীন দল সবসময় জনগনের তী ক্ষ নজরদারীতে থাকে। ফলে দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি সবার কাজ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হয়।

ভাল কাজ যেমন প্রশংসিত হয় তেমনি মন্দকাজগুলো সমালোচিত হয়।তৃনমুল পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্রই নেতাকর্মীদের কর্মকান্ড দল ও সরকারের জনপ্রিয়তার হ্রাস বৃদ্ধির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত। ২০০৯ মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সরকার নির্বাচনী ইসতেহার মেনে দেশের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। অথচ অটোপাস এমপিদের গাছাড়া ভাব। এলাকায় না থাকা, বিলাসী জীবনধারন, তৃনমুল নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক না রাখা, বিদেশ সফরে ব্যস্ত থাকার মত ঘটনায় মানুষ ক্ষুদ্ধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে বর্তমান সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।

সরকারও যথাসাধ্য প্রত্যাশা পুরনে সচেষ্ট বলে জনগন মনে করেন। কিছু বিষয়ে সমালোচনা থাকলেও সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত জনগন ইতিবাচকভাবে গ্রহন করেছে। সন্ত্রাস দমন থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নানা ক্ষেত্রে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা প্রশংসার দাবী রাখে। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংঘাত পেরিয়ে স্থিতিশীলতায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। একটি সরকারের জন্য এ বিষয়কে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। সব ধরনের বৈরিতা কাটিয়ে প্রায় পেছনের দিকে যাওয়া একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সরকারের ব্যবস্থাপনা দক্ষতারই পরিচায়ক।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সরকারের এই অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে সামান্য সংখ্যক নেতাকর্মীর অপকর্ম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে যে খবর এসেছে বা আসছে তা মোটেও ইতিবাচক নয়। তৃনমুলের দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় সংসদ সদস্যদের বিতর্কিত কর্মকান্ড দলের জন্য ক্ষতির কারন হচ্ছে। এসব এলাকায় দল জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। কোথাও কোথাও দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা সরে যাচ্ছে রাজনৈতিক প্লাটফরম থেকে। এর ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্বে দলের নেতা এমপিদের দৌরাত্ব্য অনেক স্থানেই রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে জামায়াত নেতাকর্মীদের দলে যোগদানের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে। রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার করে অনেক চুনোপুটি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ডে এরা সক্রিয় মাঠে। এরাই নিয়ন্ত্রন করে অর্থ ও বাহুবলে ক্ষমতার রাজনীতি।

ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা, তৃনমুলের লডাকু, দু:সময়ের কর্মী বা নেতারা এখন নব্য আওয়ামী লীগের ও হাইব্রীড় নেতাদের কাছে কোনঠাসা। দেশের অর্থেকেরও বেশি জেলায় ও উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দখলবাজের সংখ্যা অগনিত। এর সংখ্যা ৩৯৯ জন। ধর্ষন, হত্যা ছিনতাইয়ের মত গুরুতর অপরাধের মামলা ৩১৭জনের বিরুদ্ধে এমন তথ্য দিয়েছে সরকারের কাছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল গ্রুপিং এ প্রায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানামুখী সন্ত্রাসের অভিযোগ সরকারকে যেমন বিব্রত করছে তেমনি কিছুটা হলেও দু:চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এসব অপকর্মের হোতা এমপি ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে দলের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামতে পারে। তবে এখনই সরকারকে কঠোরভাবে রাজনীতির দুবৃত্তদের দমন করতে পারলে সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে না।

সরকারী দলের কিছু আগাছা যে চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। না হয় সাধারন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দানা বাঁধবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দলের মধ্যে ঘাটটি মেরে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা তৎপর রয়েছে। এই বিষয়টিও গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে অবহিত করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার  প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সরকারী দলের নিয়ন্ত্রনহীন সন্ত্রাসী ও বাজিকরদের নামধাম। এই প্রতিবেদন তৈরীর কাজ আরও ১০/১২ দিন চলবে। এরপর জমা দেওয়া হবে গোয়েন্দা সংস্থার  কাছে। ৩৭ জেলায় প্রায় ৪শত সন্ত্রাসীর নাম ঠিকানা সহ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার এরপর যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনে মাঠে নামবে বলে একটি সুত্র জানিয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ এলাকায় যুবলীগ নেতা মেহেদি হাসান বাদল খুনের রহস্য উদঘাটনের আগেই প্রকাশ্য দিবালোকে এসেছে ডাবল মার্ডার। হঠাৎ করে নগরীতে বেড়ে গেছে খুনোখুনির ঘটনা। এতে করে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে । পুলিশ কোনভাবেই এসব হত্যাকান্ডের ক্লু উদ্ধার বা সনাক্ত করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা মেহেদি হাসান বাদলের খুনিদের গ্রেফতার করতে পুলিশের ব্যর্থতায় এলাকাবাসী ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রামবাসী আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় থাকলেও পুলিশের কোন কম্বিং অপারেশন নেই। এমনিতেই নাকাল নগরবাসী জীবন ও জীবিকা নিয়ে। এরপর আছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধি।

নগরবাসীর নাকাল জীবন যাত্রার সাথে যোগ হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে নগরবাসী। নানা সমস্যায় জর্জরিত নগরবাসীর জন্য হঠাৎ করে আইনশৃঙ্কলার অবনতি জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে।

মানুষের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যেখানে ক্ষীন হয়ে আসে তখন অপরাধবোধ করে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে সিএমপিকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.