দুর্বৃত্তদের চাঁদাবাজিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি হুমকিতে

0

শ্যামল রুদ্র,রামগড় ::খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা ও এর আশপাশের পার্বত্য গ্রামীণ জনপদে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদল ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি ও অপহরণের মাধ্যমে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে,পার্বত্য চট্রগ্রামের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নাম পরিচয়ে বহিরাগত কতিপয় দুর্বৃত্ত এ সব অপকর্মে জড়িত। এদের সহযোগিতায় রয়েছে সুযোগসন্ধানী স্থানীয় কয়েকটি দুষ্ট চক্র। এ সব চাঁদাবাজদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের সত্যিকারের সক্রিয়তা চেয়েছেন জনসাধারন। দুর্বৃত্তদের অত্যাচার উৎপীড়ন মোকাবেলায় প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভূমিকায় এলাকাবাসী ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য উপজেলার স্পর্শকাতর অংশে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেনা সদস্যরা রয়েছেন তৎপর কিন্তু তারপরও চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ঘটনা কমেনি বলে জানা গেছে।

চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার ঘটনায় অতিষ্ঠ স্থানীয় জনসাধারন এখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিন যাপন করছেন। রামগড় উপজেলা জেএসএস (সন্তু গ্র“প) সভাপতি মংসুইপ্র“ কারবারী বলেন,এলাকায় সশস্ত্র চাঁদাবাজদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। তিনি নিজেই ভয়ের মধ্যে আছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান। উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি,অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও নিরীহ লোকজনদের ভয়ভীতির মাধ্যমে এলাকা ছাড়ানোর মতো অবনতিশীল আইন শৃঙখলা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (০৬ ,জুলাই) ৪৩,বিজিবি (বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন) রামগড় কার্যালয়ে এক মতবিনিময় ও জনসচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ৪৩, বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. জাহিদুর রশীদ পিএসসি।

“চাঁদাবাজিই শান্তি স¤প্রীতি ও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়” বিষয়ে মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত সূধিবৃন্দের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সরকার আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এলাকায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে অথচ পাহাড়ের অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে উন্নয়নের এ গতিকে বাধাগ্রস্থ করছে। সহজ-সরল নিরীহ পাহাড়িদের জুম্মল্যান্ডের! অবান্তর কথা বলে বিভ্রান্ত করছে। নানা ভাবে প্রতারিত হচ্ছেন নিরীহ লোকজন। যুব ফোরামের নামে সন্ত্রাসীরা এলাকার পরিবেশ অশান্ত করছে।ু এ ধরনের অরাজগতা চলতে দেওয়া হবে না। পাহাড়ি-বাঙালি সবাই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় এগিয়ে আসুন। তথ্য আছে, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নামে নিরীহ লোকজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা নিচ্ছে। আর এই অশুভ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছুসংখ্যক অসাধু বাঙালিও জড়িত বলে জানা গেছে। নেতিবাচক এই পথ থেকে কুচক্রিমহলকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ রশীদ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্যে আরও বলেন, যেকোন মূল্যে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বজায় রাখতে হবে। পাহাড়ি-বাঙালি সমন্বয়ে এলাকায় এলাকায় স¤প্রীতি বৈঠক করতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসীদের বিষয়ে খোজঁখবর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। বিজিবির টহল আগের চেয়ে আরও জোরদার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর হব। সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বিজিবি সব সময় প্রস্তুত।

গত ৩০জুন রামগড় কালাডেবার সোনাইআগা গ্রামে সন্ত্রাসীদের ফাঁকাগুলি ও চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙ্গালিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পারস্পরিক অনাস্থা-অবিশ্বাসে ওই সময় এক বিস্ফোরনমুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দফায় দফায় শান্তি বৈঠক করে কোনরকমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও দুর্বৃত্তদের অশুভ তৎপরতা অব্যাহত থাকলে যেকোন সময় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করেন এলাকাবাসী। রামগড় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল কাদের বলেন, ওই সময় রাত-দিন বহুবার সোনাইআগা গ্রামে গিয়ে পাহাড়ি ও বাঙ্গালিদের সঙ্গে কথা বলে উত্তেজনা প্রশমিত করা হয়েছে। তখন মানুষ হিতাহীত জ্ঞান হারিয়ে গুজবের পেছনে এতটা দৌঁড়ায় যে, তাঁদের নিয়ন্ত্রনে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। স্থানীয় নেতা ধনঞ্জয় ত্রিপুরা ও নবরায় ত্রিপুরার বলেন, এলাকায় নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপিত হলে ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) এর এ সব সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য কমতে পারে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দরকার। দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতা যেন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।

এর আগে রামগড়ের শ্মশান টিলায় চাঁদাবাজির সময় ইউপিডিএফ এর সদস্য মংসী মারমাকে বিজিবি ৬০০গ্রাম গাঁজা ও নগদ ৯হাজার টাকা সহ আটক করে পুলিশে সোর্পদ করে।মোবাইল কোম্পানীর অনেকগুলো সিম কার্ড ও মোবাইল সেট পাওয়া যায় তার কাছে। বিজিবি জানায়, সে ইউপিডিএফ এর সক্রিয় সদস্য। তার বিরুদ্ধে মাদক পাচার, চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে।

পাতাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিন্দ্র ত্রিপুরা, সাবেক চেয়ারম্যান আশুতোষ রোয়াজা ও মারমা সম্প্রদায়ের নেতা শিক্ষক রুম্রুচাই কারবারীর ভাষ্যমতে, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে পাহাড়ি-বাঙ্গালি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কিছুসংখ্যক চাঁদাবাজ হাজার হাজার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে, সবাই তাদের চেনেন। পাহাড়ের প্রত্যন্তাঞ্চলগুলো সন্ত্রাসীদের চারণ ভূমি-অভয়ারন্য উল্লেখ করে নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপশি সেনা টহল বৃদ্ধির দাবি জানান তাঁরা।

রামগড় সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহআলম মজুমদার ও আওয়ামীলীগ নেতা মো.আলমগীর তাঁদের এলাকায় চাঁদাবাজি,অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কথা নিশ্চিত করে বলেন,সন্ত্রাস প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যে কোন সময় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। এলাকাবাসী উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন। পাতাছড়ার মোহাম্মদ আলী ও আবদুল কাইয়ুম বলেন,আমরা এলাকায় যাই না। উপজেলা সদরে বাসা ভাড়া নিয়েছি। চাঁদার দাবিতে দুর্বৃত্তরা স¤প্রতি তাঁদের ও অন্যান্য অসংখ্য বাগানের হাজারো ফলন্ত আম,কাঁঠাল,লিচু গাছ কেটে ফেলে। এসব ঘটনা থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়। কিন্তু অপরাধীদেরকে প্রশাসনের পক্ষে আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু নিজেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অপরাধীদের আটক করতে প্রশাসনের আরও আন্তরিক হওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়,রামগড়ের লক্ষীছড়া,পিলাকছড়া,বেলতলি,বৈদ্যপাড়া,বড়খেদা,ছোটখেদা,ছেনচরিপাড়া,গুজাপাড়া,বালুখালী সোনাই আগা,হাতিরকুম্বা,জালিয়াপাড়া,কৈলাশটিলা,লালছড়ি,বলিপাড়া,রুপাইছড়ি, তৈচাকমা,থলিবাড়ি,হাফছড়ি,বড়ইতলা,থানাচন্দ্রপাড়া,মুসলিমপাড়া,মরাকয়লাসহ প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় সর্বত্রই সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা সক্রিয়। থানাচন্দ্র পাড়ার জলিল মিয়া ও মুসলিম পাড়ার মংহলাপ্র“ মারমা বলেন,এলাকায় চাঁদাবাজেরা খুবই বেপরোয়া। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। তাঁরা বলেন, দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন হারে চাঁদা ধার্য করে। ব্যবসায়ী,চাকুরিজীবী,গরিব কৃষক ও প্রবাসী পরিবার গুলোর আত্বীয়স্বজন সবাই নিরুপায় হয়ে নিয়মিত চাঁদা দেন সন্ত্রাসীদের। চাঁদাবাজদের উৎপাতে সরকারি উন্নয়নমূলক কাজকর্ম বাধাগ্রস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে, গত বছরের অক্টোবর মাসে রামগড়ের পিলাকঘাট এলাকা থেকে তিন বাঙ্গালি ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জেএসএস সংস্কারপন্থী অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা। অপহৃতরা হলেন, রামগড় পৌর এলাকার শ্মশান টিলা গ্রামের বাসিন্দা মো.আবুল খায়ের (৪৫), মো. শাহজাহান (৪০) ও বল্টু রামের মোস্তফা মিয়া ( ৩৫) । অপহৃত ব্যবসায়ীরা ছাড়া পেয়ে সাংবাদিকদের জানান, পিলাক ঘাট থেকে তাদের চোখ বেধে মাইচ্ছা ছড়ি এলাকায় গহীন অরন্যে আটকে রেখে ৪লাখ টাকা আনতে চাপ দেয়।
রামগড় উপজেলা নিবার্হী কর্মকতার্ (ইউএনও) মো. আল মামুন মিয়া বলেন,পার্বত্য চট্রগ্রামের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এলাকার বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো সঠিক। এ কারণে পার্বত্য এলাকায় সাম্প্রদায়িক হানাহানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম ভূইয়া ফরহাদ ও পৌর মেয়র মো. শাহজাহান কাজী রিপন উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, কয়েকটি চিহিৃত গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে এলাকায় সা¤প্রদায়িক সম্প্রতি আজ হুমকীর মুখে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের এই অঞ্চলে এ ধরনের অশুভ কর্মকান্ড আতঙ্কের বিষয়। চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তাঁরা। যেকোন ধরনের সংঘাত নিরসনে পাহাড়ি-বাঙ্গালিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন তবেই কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.