দুর্লভ খেজুর রসের চিনি

0

পাটালি গুড়, নলেন গুড়, দানা গুড় (ঝোলা গুড়) খেজুর রস বিভিন্ন রকম খেজুর গুড়ের কথা আমরা শুনেছি। বৃহত্তর যশোর, বৃহত্তর ফরিদপুর, রাজশাহী, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত।

এক সময় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে খেজুর রসের চিনি তৈরি করা হতো। হালকা সোনালি রঙের এ চিনি থেকে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন বানানো যায়। বিশেষ করে ঈদুল ফিতর, শবেবরাত ও রমজানে ইফতারিতে এসব মিষ্টি ব্যবহার হতো বনেদি মুসলিম পরিবারে।

খেজুরের চিনি তৈরি বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং যান্ত্রিক যুগে সস্তা ও সহজে আখের সাদা চিনি পাওয়ায় খেজুর চিনি উৎপাদন ও ব্যবহার প্রায় হারিয়ে গেছে।

বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীর দু-একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবার তাদের নিজের খাবারের জন্য দু-এক কেজি খেজুরের চিনি তৈরি করেন। বগুড়া আদমদীঘির জামেনা বেগম, আনোয়ারা বেগম, মনোয়ারা বেগম বলেছেন, খেজুরের চিনি তৈরি করতে ধৈর্য, শ্রম ও সময় লাগে। খরচও অনেক বেশি। মানুষ এখন দ্রুত ও সস্তায় সবকিছু পেতে চায়। শৈল্পিক সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী খাবার সস্তায় দ্রুত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি আরো বলেন, ১ কেজি নলেন গুড় থেকে ৫০০-৬০০ গ্রাম পাটালি গুড় পাওয়া যায়। আর এক কেজি নলেন গুড় থেকে ১০০-১৫০ গ্রাম চিনি পাওয়া যায়। এ চিনি পেতে ৪০-৬০ দিন সময় লাগে। ইচ্ছা করলেই সবাই খেজুর রসের চিনি তৈরি করতে পারবেন না। এসব তৈরির নানা পরিমাপ জানতে হয়। তিনি হেসে বলেন, আগে যেসব পরিবারের মেয়েরা খেজুর চিনি তৈরি ও এ চিনির দিয়ে নানা মিষ্টান্ন বানাতে জানত বিয়ের আগে সেই মেয়েদের এটা একটা বিশেষ গুণ হিসেবে ধরা হতো। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসব মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসত। নরেন্দ্র মিত্রের ‘রস’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘মাজু বিবির’ মতো (রস গল্প অবলম্বনে হিন্দি সওদাগর ছবি নির্মিত হয়েছে, যার নায়ক অমিতাভ বচ্চন) খেজুরের চিনি বানানোওয়ালীদের বেশ কদর ছিল। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে সৈয়দ মীর খন্দকার আখন্দ বাড়ির মেয়েদের কুরআন-হাদিস জানা ও শরিয়তের পাবন্দি হওয়ার সাথে নানা রকম সুঁচ ও রন্ধনশিল্প জানতে হতো। অনেকে ধৈর্য ধরে খেজুর রসের সোনালি চিনি বানাতে শিখত।

যেসব গাছের রস ঘন ও সুমিষ্ট সেই সব খেজুরগাছ বাছাই করা হতো। গাছিরা গাছ থেকে খেজুর চিনি বানানোর জন্য শুধু মাঘ মাসে যে রস হয় তাই দিয়ে চিনি বানাতো। খেজুর গাছের রস নামানোর পর গাছিরা একটি গাছ তিন দিন কেটে রস আহরণ করেন। আর তিন দিন বাদ দেন। আবার তিন দিন রস আহরণ করেন। রস আহরণে তিন দিনের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের রস চিনি বানাতে ব্যবহার হয়।

রস ধীরে জ্বাল দিতে হয় তেঁতুল কাঠের খড়ি দিয়ে। নির্দিষ্ট ঘনত্বের নলেন গুড় বা লালি তৈরি করে তা মাটির বিশেষ আকারের পাত্রে ঢেলে রাখা হয়। রস জ্বাল দেয়ার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন চিনি বানানোওয়ালীরা। পাত্রের ভেতরে যেন ছাই না পড়ে। রস জ্বাল দেয়ার সময় ছাই পড়লে চিনির রঙ ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। নলেন গুড় জ্বাল দেয়া হলে মাটির বিশেষ ধরনের পাতিলে মুখ খুলে রেখে ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর মাটির ঢাকনা দিয়ে ৪০-৬০ দিন পর্যন্ত পাতিলের মুখ বন্ধ রাখতে হয়। যারা চিনি তৈরি করেন তারা দু’হাতে পাতিল উঠালেই বুঝতে পারেন পাতিলে সর্বোচ্চ পরিমাণ স্ফটিক আকার চিনি জমেছে। আগের দিনে এ স্ফটিক আকার চিনিকে মিছরিদানা বলা হতো। ৪০-৬০ দিন পর পাতিলের ঢাকনা খুলে ভেতরের নলেন গুড় আলাদা পাত্রে ঢালা হয়। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে পাতিল ভালো করে ধোয়া হয়। পাতিলের তলায় অর্ধ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত স্ফটিক আকার স্বচ্ছ সোনালি দানা দেখা যায়। পাতিল ভেঙে অথবা অল্প তাপ দিয়ে এসব স্ফটিক দানা তোলা হয়। একটি সাদা গামলায় ঢালা হয়। তারপর আবারো ঠাণ্ডা পানিতে ধোয়া হয়। এবার স্বচ্ছ ও সোনালি রঙের স্ফটিক পাওয়া যায়। এসব গুড় করে কয়েক দিন রোদে শুকিয়ে কাচের পাত্রে রাখা হয়। এভাবে তৈরি হয় খেজুরের চিনি। এক কেজি চিনি বানাতে প্রায় ১০ কেজি নলেন গুড় লাগে। পাতিলের উপরিভাগে যে নলেন গুড় ঢালা হয় তার মিষ্টতা কমে যায়। এসব গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এক গ্লাস ঘন দুধের মধ্যে চার চামচ চিনি দিলে চমৎকার কফি কালার আসে। খেতে খুবই সুস্বাদু। এ চিনি দিয়ে সেমাই, পায়েস, ফিরনি, রিসা, সন্দেশ, লাড্ডু, দই, পোয়াপিঠা, পাটিসাপটা, কুলিপিঠা, দুধপিঠা নানা রকম পিঠা তৈরি করা যায়। এ পিঠার স্বাদ অন্য গুড় চিনির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

বর্তমান বাজারে ১ কেজি নলেন গুড়ের দাম প্রায় ১০০ টাকা। আর ১০ কেজি নলেন গুড় থেকে ১ কেজি চিনি পাওয়া যায়। এ জন্য ১ কেজি চিনি তৈরি করতে কমপে ১ হাজার টাকা খরচ পড়বে। এটি শৌখিন খাবার বাজারজাত করা সম্ভব নয় বললেন বগুড়ার আদমদীঘির হাজী নাছির উদ্দিন ও আব্দুল ওয়াহাব। যারা প্রায় ৪০ বছর ধরে খেজুরের নানা রকম গুড় তৈরি করেন। এখন হয়তো নিজেদের খাবারের জন্য আমরা ২-১ কেজি চিনি তৈরি করি। এসব বিক্রি সম্ভব নয়। সবকিছুর দাম বৃদ্ধি বিশেষ করে জ্বালানির দাম বেড়েছে অনেক। ভালো রস পাওয়া যায় না। খেজুরের গাছও কমেছে। এ এলাকায় খেজুর গুড় উৎপাদনও কমেছে। খেজুরের চিনির কথা এখন মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। এসব এখন কাগজেই লেখা থাকবে। কেউবা বাজারের চিনি মিশিয়ে ভেজাল চিনি তৈরি করবে। এ চিনি বানানোওয়ালীরা প্রায় সবাই পরপারে বিদায় নিয়েছেন। যে দুই-একজন বেঁচে আছেন তারাও প্রবীণ।

আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের মিষ্টি খেজুর থেকে এক ধরনের মিষ্টি চিনি তৈরি করা হয়। তা স্বাদে আমাদের খেজুর রসের চিনির মতো নয়। হাজী নাছির উদ্দিন বলেন, ভালো উদ্যোক্তা পাওয়া গেলে ঐতিহ্য বজায় রাখতে এই খেজুর রসের কিছু পরিমাণ চিনি তৈরি করা যেত।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.