এস এম মনসুর নাদিম,সিটিনিউজ :: পাকিস্তান কখনো অনুকরণ যোগ্য দেশ হতে পারেনা। যে দেশের জন্ম লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাচিত কোন প্রেসিডেন্ট / প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পুর্ন করার ইতিহাস নেই। (শুধুমাত্র ২০১৩’র পিপিপি’র জোট সরকার ব্যতীত।)
যারা ৭১’এ আমাদের মা / বোনদের নির্বিচারে ধর্ষন করেছিল। এই দেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। যারা বলেছিল-বাঙালি চাইনা। পুর্বপাকিস্তানের (বাংলাদেশের) মাটি চাই’।
যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাদেরকে অনুসরণ বা অনুকরণ এর ধৃষ্টতা যারা দেখাতে পারে তারা আর যাই হোক বাঙালি ও বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়।
পাকিস্তানের ক্ষমতা সার্বক্ষনিক সামরিক নজরদারিতে থাকে। মেজর / জেনারেলদের তোষামোদ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়। ৭০’র নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ট ভোট পেয়েও বাঙালিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি এই নোংরা মানসিকতার পশুরা।
আজ পাকিস্তানে যেটা হয়েছে সেটা শেষ ঘটনা না। এটার পরও ঘটনা ঘটতে থাকবে। হয়তো সেটা আরও বেশি ভয়ংকর আরও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। কেননা পাকিস্তানের ইতিহাস বারবার এটাই বলে।
যেখানে ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’। যদি হতো তবে পাকিস্তানকে অনুকরণ করা যেত। কয়জন বাঙালি পাকিস্তান এর অবস্থা আর পাকিস্তানীদের মানসিকতার খবর রাখেন ? রাজনীতির ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান।
দেশটির সাত দশকের রাজনীতির ইতিহাসে মাত্র একবার ২০১৩’তে জাতীয় সংসদ তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিল । এর মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ করার ঘটনা ঘটেছিল ।
উল্লেখ্য ২০০৮ সালে পিপিপি’র নেতৃত্বে এ সংসদ গঠিত হয়েছিল।
উলেখ্য, তৎকালীন পিপিপি’র জোট সরকারকে তিন-তিনটি সেনা ক্যু মোকাবিলা করতে হয়েছিল ক্ষমতাসীন প্রশাসনকে।পাকিস্তানের জন্মই ছিল প্রতারনার মাধ্যমে।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করার কথা থাকলেও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করে একটি মাত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম হবে বলে ঘোষণা করেন।
তার এই ঘোষণা বাঙালি নেতাদের মনে কষ্টের দানা বাঁধে। বাঙালি মুসলমানরা চেয়েছিলেন ভারতের পূর্বাংশ নিয়ে একটি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠন করা হবে।
কিন্তু ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের দলীয় আইন সভার সদস্যদের এক কনভেনশনে নীতিবহির্ভূতভাবে জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব সংশোধনের নামে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
সুতরাং বলা যেতে পারে, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে নয়, ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল উত্থাপিত দিল্লি প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। এরপর থেকে শুরু হয়েছিল বৈষম্যের সাত কাহন।
পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী এবং গভর্নর জেনারেল এ দুটি পদই তারা নেয়। সমতা এবং গণতান্ত্রিকভাবে এ দুটি পদের একটিও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো মানুষ পায়নি।
তারপর চলতে থাকে ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র। পুরো পাকিস্তানের ৫৬.৪০% লোকের মুখের ভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৩.২৭% উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। শুরু থেকেই পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা।
১৯৬২ সালে পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোতে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ৯৫৪ জনের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ১১৯ জন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২০০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯০০।
১৯৪৭ সালে করাচিতে রাজধানী হওয়ায় সব সরকারি অফিস-আদালতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যাপকহারে চাকরি লাভ করে।
পাকিস্তানের স্ব-ঘোষিত জঙ্গি ও ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রতারণা করে ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া দেশ পরিচালনা করেছিলেন।
বরাবরের মত গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানি শাসকেরা স্বৈরতন্ত্র, এক নায়কতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে থাকে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শোষণ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে উন্নতি করে।
১৯৬৬ সালে সামরিক বাহিনীর ১৭ জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১ জন ছিল বাঙালি।
এ সময় সামরিক অফিসারদের মধ্যে ৫% ছিল বাঙালি। পাকিস্তানের মোট ৫ লাখ সেনা সদস্যের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ২০ হাজার জন অর্থাৎ ৪%। দুর্নীতি আর অনিয়মের মডেল হল পাকিস্তান। আইয়ুব খানের শাসনকালে মোট বাজেটের ৬০% সামরিক বাজেট ছিল।
যার বেশির ভাগ বহন করত পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয় থেকে অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রতি ছিল চরম অবহেলা। ১৯৫৫-১৯৬৭ সালের মধ্যে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ছিল ২০৮৪ মিলিয়ন রুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি।
পাকিস্তানের ৩৫টি বৃত্তির মধ্যে ৩০টি বৃত্তি নিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান, মাত্র ৫টি বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। আর সংখ্যা লঘুরা সেখানে কেমন আছে জানতে চান ? তবে শুনুন- শোনা যায়, ওদেশে না কি মুসলমান ভাইয়েরা তিনটে অপশন দিয়ে থাকেন হিন্দুদের। যখন ঝামেলা শুরু হয় জোরদার।
১. মুসলিম হয়ে যাও, ২. পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাও (তা বলে জিনিসপত্র কিছু নিয়ে যেতে পারবে না! ওটা থাকবে পাক-মানুষের দখলে। প্রাণটা নিয়ে যেতে পারছো, সেটাই কি বড় ব্যাপার নয়?), ৩. এখানে পড়ে পড়ে মার খাও, মার খেয়ে মানুষ থেকে লাশ হয়ে যাও! সেখানে সংখ্যা লঘুরা নাকি দ্বিতীয় অপশন টাই বেঁছে নিতেন।
কারন , ইতোপুর্বে দেখেছি সিন্ধ এবং খাইবার-পাখতুনখোয়া থেকে একসময় অনেকে চলে এসেছিলেন ভারতে। সেই দলে দেব আনন্দ, রাজ কাপুর, মনোজ কুমার, যশ চোপড়া, বলরাজ সাহনি এঁরাও ছিলেন। উল্টো পিঠে, প্রায় সমপরিমাণ মুসলমান চলে যান পাকিস্তানে।
হিন্দুদের সাথে এই ব্যবহারে গত কয়েক বছর আগে পাকিস্তানি হিন্দু এম পি লাল মালহি পাকিস্তানি সংসদে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। সারাক্ষণ পার্লামেন্টের অন্যান্য সদস্যরা তাকে ‘গরুর পূজারি’ আর ‘হিন্দু হিন্দু’ বলে সম্বোধন করে।
শুনতে শুনতে শেষে ক্ষিপ্ত হয়ে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দেন পাকিস্তানি হিন্দু এমপি লাল মালহি। তিনি অধিবেশন চলাকালেই সরাসরি স্পিকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এ বিষয়ে। এ ঘটনা গত দুই বছর আগের।
তিনি বলেন, “হিন্দুরাও পাকিস্তানের নাগরিক এবং তাদের ধর্মীয় স্বীকৃতি আছে বিধায় তাদের নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করা উচিৎ নয়।”
“আমি তিন-চারদিন ধরে খেয়াল করছি বিষয়টি। একবার বলা হলো- হিন্দুরা গরুর পূজা করে। আমরা গরুর পূজা করি, এটা আমাদের অধিকার এবং আমরা এটা করবোই। আমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয় ‘হিন্দু হিন্দু’ বলে। আমরা তো পাকিস্তানিই, কিন্তু এরা আমাদের পাকিস্তানি বলতে পারে না কেন?”
স্পিকার একপর্যায়ে তাকে বসতে বললে তিনি তা অগ্রাহ্য করে বলেন, “মিস্টার স্পিকার, আমিও হাউসের রুলস অব বিজনেস পড়েছি, আর আমি এর সম্মানও করি আর আমাদের বুজুর্গ রাজনীতিকদেরও কদর করি।”
লাল ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আরও বলেন, “ভারতকে তাদের গালি দেওয়ার প্রয়োজন হলে তারা গালি দিয়ে বসে হিন্দুদের। এখানে আমাদের অপরাধটা কী? সব সময়ে এই হাউসে এটা হয়। আমি অনেকদিন ধরে বিষয়টি নোট করে আসছি।
পরশু এক হিন্দু শিশুকে অপহরণ করে জোর করে মুসলমান বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে কোনও পার্লামেন্ট সদস্য কথা বলবেন না। এখানে হাসির ছড়া কাটা হবে, ঠাট্টা করা হবে। আমরাও অন্যদের মতই একই মর্যাদার নাগরিক, আমরাও পাকিস্তানি।”
“যদি হিন্দুদের নিয়ে কেউ কথা বলতে চান, তবে ওই অপহরণ করা ১৪ বছর বয়সী হিন্দু শিশুটির কথা বলুন যাকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়েছে।”
পাকিস্তানীদের কথা মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। তারা বলবে, পাকিস্তানীরা কখনোই আমাদেরকে নাম নিয়ে সম্বোধন করেনা। বলে- হেই বাঙালি, ইয়ে বাঙালি, ওহ বাঙালি ইত্যাদি।
আজকে না শুধু, পাকিস্তান আমলেও তাইই বলতো। তারা যদি আমাদেরকে বাঙালি না ভেবে পাকিস্তানি ভাবতে পারতো তবে আজ পাকিস্তান অখন্ডই থাকতো।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।