বসন্তের কোকিল ও অতিথি পাখির ভিড় এখন আওয়ামীলীগের চৌকাঠে 

0

এস এম মনসুর নাদিম –
ধর্ম ও রাজনীতি মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে থাকে, এই উপলব্ধি হয়েছে জীবন চলার পথে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা থেকে। ওয়াহাবী-সুন্নি, আওয়ামীলীগ-বিএনপি’র অনেক কট্টর পন্থি লোকেরা বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে শুধুমাত্র ধর্মীয় ও দলীয় মতের অমিলের কারনে। মানুষ কত সংকীর্ন চিত্তের হলে এহেন কাণ্ডজ্ঞান হীন কর্ম করে থাকে তা আমার বোধগম্যের বাইরে।

অথচ সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ প্রতিহিংসা,জিঘাংসা, মারামারি কাটাকাটিতে লিপ্ত হওয়ার দরুন একটি সুন্দর শৃঙ্খলাতে মনুষ্য জীবন ফিরিয়ে আনার মানসে সৃষ্টি হয়েছিল সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা। শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান মানুষেরা সমাজ গঠনের তাগিদ অনুভব করার সাথে সাথে সমাজ গঠনের সহায়ক হিসেবে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখলেন।

এর সাথে অতি বুদ্ধিমান মানবেরা রাজনীতি যোগ করে সভ্যতার মহাসড়কে যাত্রা আরম্ভ করে দিলেন। কিন্তু এ কথা বারবার প্রমানিত হয়েছে মানুষ সামাজিক জীব। তাই মানুষের জীবনে একটি উন্নত ও সভ্য সমাজের অপরিহার্য্তাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। মানুষের কল্যাণে ধর্ম ও রাজনীতির আবির্ভাব ঘটলেও মানুষ তার নিজ স্বার্থে এই দুইটি প্রক্রিয়াকে ব্যাবহার করে বিরক্তিকর ও অশান্তি সৃষ্টির কারন রুপে পরিচিতি দানে সক্ষম হয়েছে।
আমি বারবার বলে থাকি, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। দলবদ্ধ নয়। দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে অভ্যস্ত বন্যপ্রানীরা। মানুষ যখন দলাদলিতে লিপ্ত হয়, তখন তার সমাজ ভেঙ্গে যায়। আর সমাজ যখন ভেঙ্গে যায়, তখন ভগ্ন সমাজের ফাঁক গলিয়ে আদিমতা উঁকি দেয় । সন্ত্রাস, হিংস্রতা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি ঢুকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধে। শুরু হয় সামাজিক অবক্ষয়ের।

সুতরাং একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মানে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন, তা হল, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আর এই মানিসিকতা রাজনীতি ও ধর্মীয় মানসিকতা।

আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী দল একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আওয়ামীলীগের জন্মলগ্ন থেকেই এই দলটি নানা সংকটের মধ্যে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কত বন্ধুর রাস্তা পার হয়ে আজকের এই অবস্থানে। একসময়ের আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে আওয়ামীলীগ নাম ধারন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা এই দল আজ সাড়ে পাঁচ দশকেরও অধিক সময় পর অন্যান্য দলের তুলনায় জনপ্রিয়তা শুধু ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে তা’না। জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

সত্তরের নির্বাচনে এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় লাভ করলেও জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়ে ক্ষমতার সিঁড়িতে কদম রাখতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী এই দল মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল। অতঃপর দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ।
আওয়ামীলীগ বারবার যোগ্য নেতৃত্বের গুনে রাজনীতির বড় বড় সংকটকাল অতিক্রান্ত করলেও ক্ষমতায় থাকার দরুন আওয়ামীলীগের কিছু অঙ্গ সংগঠন আজ দলটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে নানাভাবে।অসংখ্য ভুঁইফোঁড় সংগঠনের জন্ম হয়েছে দেশে-বিদেশে। ব্যাক্তি সর্বস্ব, প্যাড সর্বস্ব এই সংগঠন গুলো আওয়ামীলীগের নামে নানা কু-কর্ম করে বেড়াচ্ছে।

যখনি ক্ষমতার বাইরে থেকেছে এই দলটি, তখনি পরীক্ষিত আওয়ামীলীগ নেতারা ছাড়া কাওকে দেখা যায়নি নৌকার আশেপাশে। এক সময়ের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ছিল আওয়ামীলীগের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তি। ৫২,৬৩,৭১’এ ছিল তাদের রাজপথ কাঁপানো ভুমিকা। এই দুটি অঙ্গ সংগঠনের আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ছাত্রলীগ থেকেই জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। আজ আর সেই সেকরা (স্বর্নকার) ও নেই, সেই অলংকারও নেই। ছাত্রলীগের ছেলেদের বিরুদ্ধে কিছু বললে অনেকে ক্ষেপে যান।

তারা বুঝতে চাননা এটা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়। ছাত্রলীগে কালিমা লেপনকারীদের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে।প্রতিদিন সংবাদ পত্রের পাতায় কোন না কোন ভাবে ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম হয় –ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া’ ছাত্রলীগের হাতে অমুক খুন’ আওয়ামীলীগ নেতার পাহাড় কাটা ইত্যাদি । কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিলনা।

ছাত্রলীগে এখনো অনেক মেধাবী ছাত্র নেতা আছেন যারা দলের জন্য কাজ করছেন। ছাত্র রাজনীতিতে যাদের প্রশংসনীয় ভুমিকা ছিল আছে এবং থাকবে তারা কখনো চাঁদাবাজিতে, টেণ্ডারবাজিতে কিংবা কোন ধরনের তদবিরে কখনো ছিলেননা এখনো নেই। অভিযোগ রয়েছে, বিপরীত ধারার কিছু ছাত্র উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ছাত্রলীগে যোগদান করে দলের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের কলঙ্কিত করতে কারা আজ ছাত্রলীগ যুবলীগের ইউনিফরম গায়ে তুলে নিয়েছে, কারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে, কারা ছাত্রলীগের উজ্জ্বল অতীতকে ম্লান করার দুরভিসন্ধি নিয়েছে, কারা সরকারকে বিব্রত করার পাঁয়তারা করছে তা দেখার দায়িত্ত্ব আজ পরীক্ষিত ছাত্রলীগ নেতাদের।এবং এদের কঠোর হস্তে দমন করার সময় এসেছে। রাজনীতিকে ব্যাবসায়ীদের কবল থেকে উদ্ধার করে জনকল্যাণ মুখী করার দীপ্ত প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের যোগ্য নেতৃত্বের উত্তরসুরীদের।
আওয়ামীলীগ আর মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লিখিত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামীলীগের লোকেরা আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাই নানা কারনে অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে আওয়ামীলীগের নিকট জনগণের আবদারটা একটু বেশীই। অভিমানও বেশি। রাজ্যের অভিযোগ আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে।

আওয়ামীলীগের ভাগ্যটাই বোধহয় তার বড় শত্রু।ভাগ্যকে কখনো তার পক্ষে থাকতে দেখিনি। এটা এমন একটা দল, যেদল ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সমালোচিত (গালি খায়) হয়। আবার ক্ষমতায় থাকলেও সমালোচিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত দল আওয়ামীলীগকে স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতা থেকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দুরে রাখা হয়েছিল। এখনো প্রতিদিন আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয় বিভিন্ন টি ভি চ্যানেলে, পত্রিকার পাতায়। মজার ব্যাপার হল রাতে যারা আওয়ামীলীগ সরকারের চণ্ডীপাঠ করেছেন, তারাই সকালে উঠে বলেন এই সরকার বাক স্বাধীনতা হরণ করেছে। তা দেখে বাংলার বিবেক বোবা হয়ে যায়।

অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকদের মন খারাপ হয়। ছাত্রলীগ আর যুবলীগে ঘাপটি মেরে থাকা একশ্রেনীর নপুংসকেরা তাদের কীর্তির মাধ্যমে সংগঠনের ভাবমুর্তি ম্লান করছে ও দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিব্রত হচ্ছেন আওয়ামীলীগের পরীক্ষিত প্রবীন নেতা সহ দলের শুভার্থীরা। একদিকে ছাত্রলীগ যুবলীগের ভেতরে ভেজালের অস্থিত্ব অপরদিকে নব্য হাইব্রিড আওয়ামীলীগারদের অসংযত কথা-বার্তা সরকারের সব ভালো কাজগুলোর ওপর পানি ঢেলে দিয়েছে। এই মুহুর্তে আওয়ামীলীগে বসন্তের কোকিলদের সুরের মুর্ছনা।

সামনে আওয়ামীলীগের সম্মেলন। এই সম্মেলনকে ঘিরে চলছে পদ-পদবীর তদবীর। যোগদান ও নানা ফন্দি ফিকির। বসে নেই তাহের উদ্দীন ঠাকুর আর খোন্দকার মোস্তাক এর প্রেতাত্মারা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এলাকা গুলোতে আওয়ামীলীগের পরীক্ষিত নেতার নেতৃত্বে গ্রুপিং, বিভাজন এর পরিসমাপ্তি করে সম্মেলনে এগুলে সম্মেলন সফলতার মুখ দেখবে। যারা আওয়ামীলীগ করে, ছাত্রলীগ করে কিংবা যুবলীগ করে তাদের বোঝাতে হবে যে, কোনক্রমেই আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগে বিভাজন চলবেনা। যারাই গ্রুপিং করবে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। আজ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আছে। তাই আওয়ামীলীগে অতিথি পাখির ভিড়।

ক্ষমতার বসন্ত বিদায়ের সাথে সাথে অতিথি পাখিরা ফিরে যাবে নিজ নিজ নীড়ে। এই কথাটা আওয়ামীলীগের পাখি বিশেষজ্ঞদের বিচক্ষনতার সাথে পর্যবেক্ষন পুর্বক যথাস্থানে ব্যাবস্থাপত্র দান দলের কল্যাণে সময়ের দাবী। লক্ষ লক্ষ লোক আছে যাদেরকে আওয়ামীলীগের কোন নেতা চেনেন না নিস্বার্থভাবে তারা আজীবন আওয়ামীলীগের পক্ষে কথা বলেছেন, লিখেছেন, কাজ করেছেন। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। তারা মনে করেন, এই দেশের স্বাধীনতা’র জন্য আওয়ামীলীগের ভুমিকা অতুলনীয় এবং সিংহ ভাগ। তাই তারা আওয়ামীলীগে ভুল নেতৃত্ব দেখলে, ভুল সিদ্ধান্ত দেখলে কিংবা ভুল লোক দেখলে দুঃখ পান, ব্যাথিত হন। কারন তারা আওয়ামীলীগের অঘোষিত অলিখিত আজীবন সদস্য।

আমি বরাবরই বলি বাংলাদেশে মাত্র দুটি দল আছে। একটি আওয়ামীলীগ অন্যটি এন্টি আওয়ামীলীগ। এই এন্টি আওয়ামীলীগ দলটি ভারি। এই বৃহৎ দলটিতে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে সুদৃঢ অলিখিত ঐক্যতা রয়েছে। আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগকে লেলিয়ে দেয়া তাদেরই নোংরা রাজনীতির অংশ। তাদের রাজনৈতিক সময় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে দেশের উন্নয়ন চিন্তা থেকে বেশিরভাগ সময় তারা আওয়ামীলীগের অবনতির চিন্তায় ব্যায় করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা আওয়ামীলীগের রাজনীতির কফিনে পেরেক টুকতে চেয়েছিল।

পরে বার বার হামলা হয়েছে আওয়ামীলীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর। রাজনীতির চালে ব্যার্থ হয়ে তারা রাজনীতিবিদের জীবন সংহারে একটার পর একটা জিঘাংসার চালে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখনো এন্টি আওয়ামীলীগেরা বসে নেই। নব্য আওয়ামীলীগার, বসন্তের কোকিল ও অতিথি পাখিরা তাদের হয়ে কাজ করছে। কালিমা লাগছে আওয়ামীলীগের ওয়ালে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.