বিপ্লবী প্রীতিলতার জন্মভূমিতে শিক্ষক লাঞ্ছিত, এই লজ্জা জাতির !

0

লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য বলাই-

দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, ধলঘাট, গরিলা, উত্তর ভূর্ষি, দক্ষিণ ভূর্ষি, কানুনগোপাড়া ও চন্দনাইশের বরমা- এ এলাকাগুলোকে বলা হয় বিপ্লবীদের চারণভূমি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সংগঠক এইসব এলাকাতে সুসংগঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীকন্যা খ্যাত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর জন্মভূমি পটিয়ায়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে কালজয়ী স্মৃতি হিসেবে এই পটিয়ার নাম বারেবারে উল্লেখিত হয়। বিপ্লবীদের চারণভূমি সেই পটিয়া রাজনৈতিক ইতিহাসে এখনও বিখ্যাত। সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাসেও পটিয়ার নাম উজ্জ্বল। সেই পটিয়াতেই গত ১৪ মার্চ প্রকাশ্য দিবালোকে একটি বিদ্যাপীঠে ক্লাসরত অবস্থায় শিক্ষিকার উপর হামলা চালিয়েছে বখাটে যুবক। আমরা সেই যুবককে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

সাধারণত একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান স্বর্ণ অক্ষরে লিখা থাকবে। একদিন তাঁরা এদেশ স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। শহীদ হয়েছেন লক্ষ লক্ষ প্রাণ। সেই দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই প্রজন্মের শিক্ষার আলোকিত পথযাত্রী, জাতি গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকের গায়ে আঘাত করল একজন সাধারণ বখাটে সন্ত্রাসী। আমাদেরকে কলম ধরতে হলো আবার সন্ত্রাসের কারণে নির্যাতিত শিক্ষকের জন্য। পটিয়ায় ঘটে যাওয়া এই জঘন্য ঘটনার জন্য নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের পরিবার শিক্ষাব্রত পরিবার।

বাবা, ভাই-বোন সবাই এখনো শিক্ষক। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন অনেক ত্যাগ দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অথবা শিক্ষকের উপর মর্যাদাহানির ঘটনা চোখে পড়লে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। আজকের একজন শিক্ষককে প্রকাশ্য দিবালোকে স্বাধীন দেশে তাঁর কর্মরত স্কুলে এভাবে পেটালো, সে বিষয়ে আমি কলম না ধরে থাকতে পারলাম না। আমি উত্তর চট্টগ্রামেরই সন্তান। দক্ষিণ চট্টগ্রাম আমার পাশেই। কর্ণফুলী নদীর পাশ ঘেঁষেই বোয়ালখালী ও পটিয়ার অবস্থান। পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রাম আমার পূর্ব থেকে চেনা।

আমি যখন কানুনগোপাড়া ও পটিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম এই গ্রামের সবুজ শ্যামল পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আজও আমি সেই স্মৃতি ধারণ করি। পটিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদের কন্যা শিক্ষিকা মিসফা সুলতানাকে লাঞ্ছিত এই ঘটনায় চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে আলোচিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদেশের মানুষ এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার কামনা করেছেন। গত দুই দিনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক একাধিকবার গাড়িঘোড়া বন্ধ করে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে শিক্ষক সমাজ ও সাধারণ নাগরিক। এতে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন। সকলের একটিই দাবি ঘাতক টুটুলের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে সমগ্র জাতির কাছে শিক্ষকের উপর হাততোলা অপরাধকে চিহ্নিত করে শিক্ষক সমাজকে যথার্থ মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা।

পত্র-পত্রিকায় এই নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পটিয়ায় এক শিক্ষিকাকে খন্তা দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। ওই শিক্ষিকার নাম মিসফা সুলতানা (২০)। তিনি উপজেলার নাইখাইন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের কন্যা। মিসফা পূর্ব ডেঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। ১৪ মার্চ ২০১৭ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় স্কুলে ক্লাস চলাকালে এলাকার কথিত বখাটে আহসানুল্লাহ টুটুল (২৮) এ হামলা চালায়।

টুটুল এই এলাকার আনোয়ার হোসেনের পুত্র। আহত শিক্ষিকাকে প্রথমে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পুলিশ বখাটে টুটুলকে গ্রেফতার করেছে মর্মে সংবাদপত্রে প্রকাশ। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক শিক্ষক পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিস এলাকায় বিক্ষোভ করতে করতে পরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়ক হয়ে মিছিল সহকারে পটিয়া থানা ঘেরাও করে। শিক্ষিকা মিসফা সুলতানা উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের ডেঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছে।

স্কুলে যাতায়াতের সময় এলাকার বখাটে টুটুল প্রায় বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করত ওই শিক্ষিকাকে। এক পর্যায়ে টুটুল প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় টুটুল ক্ষুব্ধ হয়ে মঙ্গলবার সকালে ক্লাস রুমে ঢুকে লোহার খন্তা দিয়ে মিসফাকে বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। এসময় ক্লাসের ছাত্র ও স্কুলের অন্য শিক্ষকরা চিৎকার শুরু করলে বখাটে ওই যুবক পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে টুটুলকে গ্রেফতার করে সক্ষম হয় বলে জানা যায়। শিক্ষিকাকে উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি এর আগে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোতাহের বিল্লাহকে জানানো হয়েছিল বলে শিক্ষিকার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তা ঐ বিষয়ে কোনো সুরাহা করেননি। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মোতাহের বিল্লাহ।

তিনি বলেন, কোনো শিক্ষক স্কুল শিক্ষিকাকে উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে কোনো দিন আমাকে বলেনি। শিক্ষিকাকে রক্তাক্ত জখম করার খবর পেয়ে তিনি (শিক্ষা কর্মকর্তা) দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তবে ঘটনার সময় ঐ এলাকার নাজিম উদ্দিন মেম্বার দ্রুত না গেলে ওই শিক্ষিকাকে প্রাণে রক্ষা করাও যেতো না বলে এলাকাবাসিরা জানায়। পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মো. নেয়ামত উল্লাহ জানিয়েছেন, বখাটে যুবক কী কারণে স্কুল শিক্ষিকাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছে তা জানি না। তবে ওই বখাটেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাকে রিমান্ডের মাধ্যমে বিষয়টি দেখা হবে। এ ব্যাপারে পটিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।” পটিয়ায় স্কুলের ক্লাসরুমে শিক্ষিকাকে নির্যাতনের প্রতিবাদে পটিয়া ও চট্টগ্রামে পৃথক পৃথক মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

শহীদ মিনারের সামনে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ সভায় সংগঠনের সভাপতি সোহেল মো. ফখরুদ-দীন বলেছেন, পটিয়া বিপ্লবীদের চারণভূমি। নারী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক বিপ্লবী প্রীতিলতার জন্মভূমি। সেই প্রীতিলতার জন্মভূমিতে আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক মিসফা সুলতানার উপর হামলা ও লাঞ্ছিতের ঘটনা পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। একজন শিক্ষক তাঁর ক্লাসরুমে পবিত্র দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বখাটে যুবক এভাবে হামলা করবে, আর আমরা তা চেয়ে চেয়ে দেখব, তা হবার নয়।

আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। একজন শিক্ষকের গায়ে সন্ত্রাসীর হামলা এটি মেনে নেওয়া যায় না। আহত শিক্ষকের পিতা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা আমাদের এই বাংলাদেশ গড়ার পেছনে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ। সেই মুক্তিযোদ্ধার কন্যা শিক্ষিকা মিসফা সুলতানাকে এভাবে নির্লজ্জ হামলার মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করলাম এখানে শিক্ষকের মান মর্যাদা বলতে কিছুই আমরা অক্ষুণ্ম রাখতে পারি না। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে আমাদের সমাজ ও দেশ ব্যর্থ নয় কি? যে দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী।

যে দেশে সংসদীয় স্পিকার নারী। যে দেশে বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী। সেই বাংলাদেশে একজন নারী শিক্ষককে এভাবে অপমান, লাঞ্ছনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো নারীর মান মর্যাদা কোথায়। আমরা আশা করব এই ঘটনাটি দৃষ্টান্তমূলক শান্তির মাধ্যমে পুরো জাতিকে শিক্ষকের মান মর্যাদায় রক্ষায় সরকারের ভাবমূর্তি প্রকাশ ঘটাবে এটা আমরা বিশ্বাস করি। আশা করি শুধু ঘাতক টুটুল নয়, টুটুলকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে তাদেরকেসহ আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে শান্তি প্রদান করবে।

লেখক:গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.