রোহিঙ্গা ট্রাজেডি ও বিপন্ন মানবতা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটিনিউজ : মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু থানার অনেকগুলো পাড়ায় দেওয়া আগুনের ধোঁয়া ছোট্ট নাফ নদীর উল্টো দিকে বাংলাদেশের শাহপরীর দ্বীপ থেকে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা অনেক নারী পুরুষ কেউ নির্বাক হয়ে, কেউ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিজের বাড়ি পোড়ানোর দৃশ্য দেখাচ্ছিলেন। এর মধ্যে শাহপরীর দ্বীপের ঠিক উল্টোপাশে গর্জনদিয়া নামের একটি পাড়ার বাসিন্দা আবদুল হামিদও দেখাচ্ছিলেন নিজের এবং স্বজন-প্রতিবেশিদের ঘর পোড়ানোর এই দৃশ্য।

হামিদের দৃষ্টি বাড়ি পোড়ানোর এই দৃশ্যে নিবিষ্ট হয়ে থাকলেও মন পড়ে ছিল একই জেলার অন্য এক থানা ভুসিডং এর ইনসং মহল্লায়। নিজ বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দুরের এই মহল্লায় তার নানা বাড়ি। সেখানে বাস করতেন অনেক স্বজন। এক মামাতো ভায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছেন হামিদ। তিনি জানাল, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়িতে হানা দেওয়ার পর থেকেই তার স্বজনদের অনেকে চলে গেছেন পাশের বনে। এরপর সেখানেই আটকা পড়ে আছেন তারা। কে মারা গেছে, কে বেঁচে আছে সেই হিসেব এখনও করা হয়নি।

বনে পালিয়ে গিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানান হামিদের সেই ভাই। তিনি হামিদকে জানিয়েছেন, ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে তাদেরকে খেতে হচ্ছে এখন গাছের লতাপাতা। তার ভাষ্য মতে, চারদিকেই রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রহরা। এ কারনে কেউ সেখান থেকে বের হতেও পারছেন না। হামিদের আশঙ্কা, তার নানা বাড়ির সব স্বজন মারা পড়বেন এভাবে। শহপরীর দ্বীপের রয়েছে দুটি অংশ। মিয়ানমারের কাছাকাছি অংশটিতে যেতে নৌকা বা স্পিড বোটে উঠতে হয়। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা এখানেই নামেন।

দুপুরে শাহপরীর দ্বীপে নেই নৌকা। ছোটাছুটি করতে দেখা গেল এক নারীকে। মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছিলেন তিনি। কয়েকটি শিশু তাকে ঘিরে ছুটোছুটি করছে। এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে যেতেই হাসিনা আক্তার নামে ওই নারী জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে তার স্বামী। সন্তানদের নিয়ে কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। হাসিনার স্বপ্ন ছিল একদিন স্বামীর ভিটায়। কিন্তু এখন তিনি দেখছেন পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, মহল্লায় সেনা সদস্যরা আসলে তিনি অন্য পাড়ায় চলে গিয়েছিলেন। পুরো মহল্লায় আগুনে জ্বলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখের পানি কোনভাবেই বাধ মানছিল না হাসিনার।

শাহপরীর দ্বীপের ঘাটে বসে বাড়ি পোড়ানোর দৃশ্য দেখছিলেন নুর বেগমও। পাড়ায় কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,’ পুরুষদের জবাই করে দেয়। কেটে টুকরো টুকরো করে শিশুদের। আরেক নারী সিতারা বেগমের স্বামী সিতারা বেগমের স্বামীও মারা গেছেন সেনা অভিযানে। স্বামীকে কবরস্থানে নিয়ে কবর দিয়েও আসতে পারেননি তিনি। সুযোগে ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। এখন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে দেখছেন স্বামীর ঘর পোড়ানোর দৃশ্য। প্রযুক্তির কল্যানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের নৃসংসতা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লেও অং সান সুচি বরাবর অস্বীকার করে আসছে।

কখনো বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে! রোহিঙ্গা নারী পুরষদের আগুনে পোড়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা করা, শরীর কেটে টুকরো টুকরো করা, নারীকে ধর্ষন করে গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন দেয়া সকল অমানবিক ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে আমাদের দেশ। আশ্রিত ৮ লক্ষাধীক রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেয়া হয়েছে আশ্রয়। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। সরকার ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে সফল হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গেছেন রোহিঙ্গাদের দেখতে। তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে তাদের। এ কথাও শোনা যাচ্ছে রোহিঙ্গা নিধন বিষয়ে জাতীসংঘের সাধারন পরিষদে আসন্ন অধিবেশনে উত্থাপিত হবে বলে ইন্দোনেশিয়া হুমকি দিয়েছে। তবে মিয়ানমারের চির পরীক্ষিত বন্ধুদেশ চীন ভোটে ক্ষমতা প্রয়োগে আঁটঘাঁট বেঁধে রয়েছে। আগষ্টের ২৫ তারিখ থেকে ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রান বাচাতে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। রাখাইন রাজ্যে আরও ৩ লক্ষাধিক লোক ঝুঁকিতে আছেন। বেঁচে আছেন নাকি মেরে ফেলা হয়েছে তা কেউ বলতে পারছেন না।

এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ তৎপর তুরস্ক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ মনে করে তাদেরকে নিরবিচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন বিষয়। রোহিঙ্গাদের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া সহানুভুতি প্রকাশ করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্বহীন জীবনযাপন করছে দীর্ঘদিন। তাদের অবাধে চলাচলের সুযোগ নেই। তাদের জন্য আইডি কার্ড নেই। তাদের পক্ষে আইনী সহায়তা নেই। তাদের অপরাধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে কথা বলায় মিয়ানমারের সর্বাধিনায়ক অং হিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভুমিকার কথা তুলে ধরেন।

১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। আরাকান রোহিঙ্গাদের জন্য সৃষ্টি হয়নি আলাদা রাজ্য। বার্মার অন্তর্ভুক্ত হয়নি রাখাইনরা। ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে-উইন ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। মিয়ানমার রাষ্ট্রের বয়স ৬৯ বছর ৮ মাস। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ৪৬ বছর ৬ মাস। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মগের এই মুল্লুকব্যাপী যে বর্বরতা, হত্যা-লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অমানবিক এবং আপত্তিকর কার্যক্রম চললেও মুসলিম বিশ্ব তেমন সোচ্ছার নয়।

আশার কথা হচ্ছে,মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী যে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে তার অনেক প্রমাণ তাদের কাছে আছে জানিয়েছে, আর্ন্তজাতিক মানবাদিকার সংস্থা এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল। স্যাটেলাইট থেকে তোলা রাখাইন রাজ্যের অনেক ছবি বিশ্লেষন করে এমনেষ্টি জানিয়েছে, সেখানে গত তিন সপ্তাহে আশিটিরও বেশি স্থানে বিশাল এলাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে এমন সংঘবদ্ধ দলগুলো একসাথে মিলে জ্বালাও পোড়াও চালাচ্ছে। তাদের মতে, এটা পরিস্কার যে সুপরিকল্পিতভাবে এসব সহিংসতা চালানো হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকট নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরেক দফা বেড়েছে।

লন্ডনে সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্মী বাহিনীর সহিংসতা মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। তিনি বলেন,’অং সান সুচি যে কঠিন এবং জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি। ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবিস জনসন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের উপর মানবাদিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে মিয়ানমারের প্রকৃত ক্ষমতাধর নেতা অং সান সুচিকেই তার নৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে। জাতীসংঘ শিশু হতবিল ইউনিসেফের যোগাযোগ বিষয়ক দক্ষিণ এশীয় প্রধান জেন জ্যাকুয়েস বলেন, এত বেশি রোহিঙ্গা আসছে যে তাদের ব্যাপারে আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। মিয়ানমারের রাখাইন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত নতুন এলাকায় দেশটির সেনাবাহিনী আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ছক বাস্তবায়ন করছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাদিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ।

এমনেষ্টির পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্ত্বিক সংস্থাটি বলেন, লোকজনকে তাদের বাড়িঘর ছেলে যেতে বাধ্য করার পর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জাতীগোষ্টির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধযজ্ঞের প্রধান কার্যক্রম হয়ে উঠেছে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মতে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানে অন্তত ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের বর্বরোচিত অভিযানের মুখে অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

দীর্ঘসময় সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের গনতন্ত্র পুরোটাই ফাঁকি। এখনো দেশটির ভাগ্যবিধাতা সেখানকার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধসন্ত্রাসীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশের আকাশ সীমায় মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ঢুকে পড়াকে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধানোর মত ঠেকালেও আমরা বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। গনতন্ত্র ও মানবিকতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার দেশ চালাচ্ছে। জানা গেছে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাখাইন রাজ্যের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি যথেষ্ট পরিচর্যা করা হয়েছে। সীমান্তে মাইন পুতে রাখা হচ্ছে। যাতে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা স্বভুমে ফিরতে না পারেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.