২২৩ বছরের পথচলা রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন থেকে বিজিবি

0

শ্যামল রুদ্র, রামগড় (খাগড়াছড়ি): বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি সীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাস ও চোরাচালান প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী আধাসামরিক বাহিনী। মূলত সীমান্ত এলাকা জুড়ে এ বাহিনীর কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জানমাল রক্ষায় দেশের নানা প্রান্তে সেনাবাহিনীর পাশাপশি এদের বলিষ্ঠ ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজিবির (তৎকালীন ইপিআর) অকুতোভয় বীর সদস্যরা জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পিলখানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমনে বহু বাঙালি সদস্য শহীদ হন। ওই রাতে ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলীর দৃঢ়তায় সিগন্যাল কেন্দ্রের সদস্যরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষনা নিজস্ব ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ মাতৃকার সম্মান বাঁচাতে অকাতরে জীবন বির্সজন দিয়েছেন বিজিবির চিরঞ্জীব মুক্তিযোদ্ধারা। প্রায় ১২ হাজার বাঙালি ইপিআর সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।

এর মধ্যে ৮১৭ জন সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। স্বাধীনতার বেদিমূলে জীবন উৎসর্গকৃত মহান প্রাণ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নুর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ আবদুর রউফ বিজিবিরই গর্বিত সদস্য।
কিন্তু সবাই কি জানেন সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী এই বাহিনীর জম্ম হয়েছিল আজ থেকে ২২৩ বছর আগে, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ের মাটিতে।

ওয়েভ সাইট ও রামগড় বিজিবি জোন সূত্রে জানা যায়, ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন স্বল্প পরিসরে মাত্র ৪৪৮জন সৈনিক নিয়ে এই বাহিনীর যাত্রা শুরুহয় ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামে যা বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সংক্ষেপে বিজিবি নামে পরিচিত। যাত্রা শুরুর স্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে রামগড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ সাজানো হয়েছে একটি বৃত্তাকার প্লাটফরমে যার বিভিন্ন অংশগুলো বিজিবির প্রতীকস্বরুপ। সামনের ধাপে আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা উঁচু দেয়ালটি স্মৃতিস্মম্ভে প্রবেশের নির্দেশক। এ দেয়ালে পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিজিবির বিবর্তনের আটটি অবয়ব। ধারাবাহিক ইতিহাস শ্বেত পাথরে লেখা রয়েছে।

প্লাটফরমে স্থাপন করা হয়েছে চারটি আরসিসি পিলার যা সীমানা পিলারের প্রতীকী রুপ। সীমানা পিলারের গায়ে ধাতব অক্ষরে খচিত হয়েছে বিজিবির যাত্রাকাল ও স্থান। প্লাটফরমের পেছনের অংশে স্থাপন করা হয়েছে একটি আরসিসি দেয়াল এবং দেয়ালের সামনের অংশে আয়তাকার বেদীর ওপর একটি ধাতবস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে যা সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী বিজিবি সৈনিকের অস্ত্র অর্থাৎ একটি রাইফেলের প্রতিমূর্তি।

রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন ( ১৭৯৫-১৮৬০ ): ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামে এই বাহিনীর জন্ম হয়। তখন এই বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪৮ জন । ছয় পাউন্ড গোলা, চারটি কামান ও দুটি নিয়মিত অশ্বারোহী দলের সমন্বয়ে জন্ম নেয় রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন।

ফ্রন্টিয়ার গাডর্স (১৮৬১-১৮৯০ ): ১৮৬১ সালে নিয়মিত ও অনিয়মিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন পর্নগঠিত হয়। এর নতুন নাম হয় ফ্রন্টিয়ার গাডর্স। সৈন্য সংখ্যা বেড়ে হয় ১৪৫৮জন। চট্রগ্রামে হয় সদর দপ্তর। তখন সীমান্ত ফাঁড়ি কামরুপ, গোয়াল পাড়া, লক্ষ্মীপুর, সিলেট ও ত্রিপুরা ছিল চট্রগ্রামের অধীন। ১৮৭৯ সালে স্পেশাল রিজার্ভ কোম্পানি নামে এর সদস্যরা ঢাকার পিলখানায় প্রথম ঘাঁটি স্থাপন করে। তখন থেকে এখনও ঢাকা পিলখানা বিজিবির সদর দপ্তর।

বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ (১৮৯১-১৯১৯): ফ্রন্ট্রিয়ার গাডর্স বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ নাম ধারণ করে ১৮৯১ সালে। চার কোম্পানিতে ভাগ হয় ব্যাটালিয়নটি। কোম্পানিগুলো স্থানান্তরিত হয়- ঢাকা, খুলনা, ভাগলপুর, ও গ্যাংটক। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক হন একজন ইউরোপীয় সুবেদার।

ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস (১৯২০-১৯৪৬): ১৯২০ সালে বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশের পুন: নামকরণ হয় ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস’। এ সময় ১৬টি প্লাটুনে বিভক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। প্লাটুনগুলো সীমান্তরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়।

ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস (১৯৪৭-১৯৭১ ): ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এটি আবার নাম পরিবর্তন হয়ে ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’ সংক্ষেপে ইপিআর নাম ধারণ করে। তখন কোলকাতা মেট্রোপলিটন আমর্ড পুলিশের কয়েকজন বাঙালি সদস্য এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ১০০০ প্রাক্তন সৈনিক এই বাহিনীতে যোগ দেন। পরে আরও তিন হাজার বাঙালি সৈনিকের সমন্বয়ে সুসংগঠিত হয় ইপিআর বাহিনী। চৌকস নেতৃত্ব ও সঠিক দিক নির্দেশনার লক্ষ্যে সে সময় ইপিআরে সেনাবাহিনী থেকে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

১৯৫৮ সালে চোরাচালান দমনের দায়িত্ব পায় ইপিআর। দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ১৯৫৮ সালে ব্রাক্ষèণবাড়িয়ার ১নং ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর তোফায়েল আহমেদ জীবন উৎসর্গ করে শীহদ হন। তাঁকে তৎকালীন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘ নিশান-ই হায়দার’ এ ভূষিত করা হয়। প্লাটুন কমান্ডার শহীদ নায়েব সুবেদার মো. আজম অর্জন করেছিলেন ‘সিতারা-ই-জরাত’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর রয়েছে গৌরবোজ্জল অবদান। বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৪২ জন সদস্য জাতীয় খেতাব অজর্ন করেছেন। এর মধ্যে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেয়েছেন শহীদ ল্যান্স নায়েক নুর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ। বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন নয় জন, বীরবিক্রম ৪০জন এবং বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন ৯১জন।

বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর (১৯৭২-২০১০): :দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৩মার্চ ইপিআরের নতুন নামকরণ হয় বিডিআর। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালের ৩মার্চ রাইফেলস সপ্তাহ প্যারেড অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম জাতীয় পতাকা প্রদান করেন।

বিজিবি স্মৃতিফলক ‘রাইফেলস স্মৃতিস্তম্ভ’ ২০০৫ সালের ৬জুন রামগড় উপজেলা কার্যালয় সংলগ্ন বিওপির সম্মুখে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। স্মৃতিফলক উম্মোচন করেন বিজিবির (তখন বিডিআর) তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এনডিসি,পিএসসি। মহাপরিচালক ওই সময় বলেন, রামগড়ের মাটিতেই বিজিবির জম্ম হয়েছিল ১৭৯৫ সালে। তাই রামগড়বাসী সৌভাগ্যবান। একটি বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার তারা। সোনালি অতীতকে সমুজ্জল রাখতে সবাইকে আন্তরিক হতে বলেছিলেন তিনি। জেনারেল জাহাঙ্গীর স্মৃতিফলক প্রাঙ্গণে ওই সময় একটি গাছের চারা রোপণ করেন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি(২০১০-বর্তমান): ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানা ট্রাজেডির পর বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে ২০১০সালের ২০ ডিসেম্বর বিজিবি দিবস ঘোষনা করা হয়। ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিবি পতাকা হস্তান্তর করেন।

এদিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রামগড় ৪৩ ,বিজিবি প্রধান কার্যালয়ে ২০ডিসেম্বর বিজিবি দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিজিবি সূত্র জানায় ২০,ডিসেম্বর এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে বিজিবির গৌরব গাথা তুলে ধরা হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.