মা মানে অবারিত আকাশ

0

মা, জননী, মাতা, দেবী, স্নেহময়ী, গর্ভধারিনী, জন্মদাত্রী, মমতাময়ী, ছায়াবৃক্ষ। যাকে অনেক নামে বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। মায়ের কত বিশেষণ তা বলে শেষ করা যাবেনা। “মা” শব্দটি শুনলেই অমিয় সুধায় প্রাণ ভরে যায়। জগতের মধুরতম শব্দ “মা” কেবল শব্দই নয় বরং বলা যায় একটি বর্ণ। “মা” ক্ষুদ্র একটি শব্দ, কিন্তু এর ব্যাপকতা বিশাল। মা শব্দে আছে সবচেয়ে অধিক আকুলতা, আবেগ, মায়া, মমতা ও নিবিড় টান। মা মানে অবারিত আকাশ, পরম মমতা, প্রতিদিনের পরম সঙ্গী, একটি অনুভূতি, উষ্ণ ভালোবাসা। “মা” ডাকে পৃথিবীর সব সুখ শান্তি লুকিয়ে আছে। মায়ের বুকেই নিহিত আছে স্বর্গসুখ। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অকৃত্রিম। মায়ের মমতা অতুলনীয়। মায়ের ভালোবাসা অমলিন। পৃথিবীতে সব ভালোবাসার মাঝে স্বার্থ থাকে, কিন্তু সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা নিখাদ। পৃথিবীতে এত অসীম সম্পদের মধ্যে একমাত্র মা-ই তুলনাহীন। মা ও সন্তানের সম্পর্ক জগতের সব সম্পর্কের উর্ধ্বে। মায়ের কোলেই সন্তান খুঁজে পায় নিরাপদ আশ্রয়। আমরা মায়ের কাছেই প্রথম কথা বলা শিখি। এই মর্ত্যলোকে মায়ের অবস্থান সর্ব উর্ধ্বে। তাই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মায়ের পদ তলে সন্তানের বেহেশত”। “সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার, তুমি কোনদিন কারো করোনি অবিচার, কারোও দাওনি দোষ, ব্যাথা বারিধির, কূলে বসে কাঁদ মৌনা কন্যা ধরণীর।” কবি নজরুল তার কবিতায় মায়ের কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন।
গর্ভধারিনী মা, যিনি দশমাস দশদিন গর্ভধারণ করে অসহ্য যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সন্তান প্রসব করেন। প্রসব যন্ত্রণায় অনেক মা অকালে প্রাণ হারান। পৃথিবীতে প্রসব যন্ত্রণার চেয়ে অধিক কোন যন্ত্রণা মনে হয় নেই। জন্মদাত্রী মা তার সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর তিনি সকল যন্ত্রণা ভুলে যায় এবং তার মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মা হওয়া কি যে আনন্দ, শুধু তা মায়েরা জানেন। মা নাওয়া, খাওয়া ভুলে তার সন্তানকে লালন পালন করে ধীরে ধীরে বড় করে তুলেন। মা তার সন্তানকে বড় করতে কতই না কষ্ট করেন কিন্তু এ কষ্ট মা কোনদিন কেউকে বুঝতে দেন না। সন্তানের রোগে, শোকে, বিপদে, দুঃখে মা ছায়ার মতো পাশে থাকে। সন্তানের সুখের জন্য একমাত্র মা-ই সব কষ্ট যন্ত্রণা মাথা পেতে নেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও মা তার সন্তান আগলে রাখেন। শত কষ্টের মাঝেও মা তার সন্তানের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন। মা সন্তানের দুমুঠো অন্ন সংগ্রহের আশায় জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সন্তানের সকল আবদার, অভিমান মায়ের কাছে। মায়ের কোন শ্রেণী ভেদ নেই। সন্তান যখন অপরাধ স্বীকার করে তখন মা আপন মহিমায় সন্তানকে ক্ষমা করে দেন। একজন মা তার সন্তানের জন্য সবসময় উদগ্রীব থাকে। তার সন্তান কখন ঘরে ফিরে আসবে। মা তার সন্তানের দুঃসংবাদ কথা শুনলে বিচলিত হয়ে পড়েন,আর সুসংবাদ শুনলে মায়ের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। অনেক সময় সন্তানের দায় দেখে অকালে মা প্রাণ হারান। শত কষ্টের মাঝেও মা তার সন্তানকে মায়া মমতায় আগলে রাখেন কিন্তু সন্তানেরা কি মায়ের কথা মনে রাখে? বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর তার গানের মাধ্যমে মায়ের কথা এভাবে প্রকাশ করেছেন, “মায়ের একধার দুধের দাম,কাটিয়া গায়ের চাম, পাপস বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না। এমন দরদী ভবে কেউ হবে না, কেউ হবে না আমার মাগো।” তাই এই পৃথিবীতে মায়ের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কারো নেই।
জীবন সায়াহ্নে এসে সন্তানের কাছে মা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবে দেখেছি সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উপার্জনক্ষম হয় এবং বিয়ে শাদী করে সংসার জীবন আরম্ভ করে, তখন অনেক গর্ভধারিনী মায়ের সে সন্তানের কাছে স্থান হয়না। মায়ের কপালে জোটে না দু’বেলা অন্ন। সন্তান তার স্ত্রীর প্ররোচনায় বা অন্য কারণে মাকে অনেকে কষ্ট দিয়ে থাকেন। হাল আমলে ঝামেলা মনে করে অনেকে পিতামাতকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে অনেক সন্তান স্বস্তি বোধ করেন কিন্তু যারা এমনটি করেন তারা কি কোন সময় ভেবেছেন তারাও একদিন বৃদ্ধ হবেন। তখন তাদের বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হবেনা তার নিশ্চয়তা কি। এই মূহুর্তে যথার্থ হবে জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী নাচিকেতার গানটির, “ছেলে আমার মস্ত বড় মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার, নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি, সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি, ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।” একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা উল্লেখ না করলে নয়। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার গত ০৮ অক্টোবর ’১১ তারিখের ক্রোড়পত্রের একটি বিরল ও মর্মান্তিক ঘটনা পাঠে নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি, “গাজীপুর জেলায় খতিব আবদুল জাহিদের প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমে এক হতভাগিনী মা মারা গেলে সে বৃদ্ধাশ্রমের অফিস থেকে তার পুত্রের কাছে ফোন করে তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ অবহিত করা হয় এবং তথায় আসতে বলা হয়। তিনি গাজীপুরের কোনাবাড়িতে চাকরি করেন। তিনি আসবেন বলে কথা দিলে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রেও না আসলে কতৃপক্ষ সে পুত্রের মোবাইলে কয়েকবার যোগাযোগ করলেও সে মোবাইল রিসিভ করেনি। পরে জানাযা শেষে সমাধিস্থ করার সময় কতৃপক্ষ তার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে সে পুত্র জানায়, তার মায়ের লাশ দেখতে আসার সময় তার নেই, তার মাকে যেন দাফন করে কবর দিয়ে দেওয়া হয়।” জীবনের অন্তিম মূর্হুতেও গর্ভধারিনী মাকে দেখতে সময় হয়না, সে সন্তানের প্রতি ধিক্কার জানানো ব্যতীত আর কি আছে। মাকে যারা কষ্ট দেয় তারা মানুষ কিনা, প্রশ্ন জাগে।
পবিত্র কোরআনের সুরা আন নিসাতে বর্ণিত আছে, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তার সাথে শরিক করবে না এবং পিতামাতার প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে।” ইসলাম মা হিসেবে নারীকে সন্মান ও মর্যদার উচ্চাসনে সমাসীন করেছে। সন্তানকে সুশিক্ষিত গড়ার ক্ষেত্রে একজন মা হচ্ছেন সুনিপুণ কারিগর। তাই প্রখ্যাত দার্শনিক নেপেলিয়ান বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।” দার্শনিক বাটর্্্রন্ড রাসেলের মতে, “একজন আদর্শ মা পরিবারের মূখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উপহার দিতে পারে উন্নত সমাজ ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।” সন্তানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে একজন মা-ই পারেন সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে।
অনেকদিন থেকে চেষ্টায় ছিলাম মাকে নিয়ে আমার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করবো, কিন্তু পারছিলাম না। মাকে নিয়ে লিখা খুবই কষ্টকর, কারণ মাকে নিয়ে লিখতে গেলে মায়ের স্মৃতি বেশী মনে পড়ে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। মা ছিল আমার পৃথিবী। মা আমার আজ বেঁচে নেই, মা হারিয়ে আমি পৃথিবীর অমূল্য সম্পদকে হারিয়েছি। আমার মমতাময়ী মা একজন আদর্শ মহীয়সী নারী এবং অত্যন্ত শান্ত ও চাপা স্বভাবের একজন রমনী ছিলেন। প্রাচুর্য্যরে মাঝেও থাকলেও তিনি খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। মাকে খুবই ভালোবাসতাম। মাকে সেবা যতœ করার আমার সুযোগ হয়েছিল। শহরে থাকার যথেষ্ট সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও আমার মা গ্রামের নির্মল পরিবেশে থাকতে ভালোবাসতেন। প্রতি সাপ্তাহের শুক্রবার মা আমার পথপানে চেয়ে থাকতেন, কখন আমি বাড়ি ফিরছি। আমি শহর থেকে বাড়িতে গেলে দেখতাম মায়ের বাঁধভাঙা আনন্দ। বৃদ্ধ বয়সেও মা আমার প্রতি যে আদর, যতœ, ছিল, তা কখনও ভুলার নয়। আজ পৃথিবীতে আমার মা নেই কিন্তু রয়ে গেছে অনেক স্মৃতি। এখনও মায়ের কথা মনে পড়লে অশ্র“জলে বুক ভেসে যায়। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর অপরাহ্নে আমার মা জান্নাতবাসী হন। মৃত্যু পূর্ব দুই বিনিদ্র রজনীতে মায়ের শিয়রে বসেছিলাম কিন্তু মা অন্তিম শয়নেও দেখেছি আমার জন্য দোয়া করতে। হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, পিতামাতার দোয়া সন্তানের জন্য বেশী কবুল হয়। মা তোমাকে খুবই ভালোবাসি, মা তুমি পরপারে ভালো থেকো।
আজ বিশ্ব মা দিবস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিমিত্তে বিংশ শতাব্দীর শেষে পশ্চিমা সভ্যতার প্রবর্তিত একটি বাৎসরিক উৎসব। ১৮৬৪ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রে আনা জার্ভিজ নামক এক নারী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করে। ১৯০৫ সালে তিনি মারা গেলে তার কন্যা আনা মারিয়া রিভস জার্ভিজ মায়ের কর্মকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্যেগ গ্রহণ করলে তার সন্মানে ১৯০৮ সালে পালন হয় বিশ্বে প্রথম মা দিবস। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। এখন পৃথিবীময় মা দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করার প্রথা খুব বেশী দিন নয়। তথ্য প্রযুক্তির মহাসড়কের পথ ধরে মূলতঃ পশ্চিমা সে সব অনুসঙ্গ আমাদের নাগরিক জীবনে এসেছে, তারই ধারাবাহিকতায় মা দিবস পালনও সেগুলোর মধ্যে একটি। গর্ভধারিনী মাকে ভালোবাসার জন্য কোন বিশেষ দিনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। বছরের ৩৬৫ দিনইতো মায়ের জন্য। মায়ের পৃথক দিন নয়, মাকে ভালোবাসার দিন হোক প্রতিদিন। শুধু মা দিবসে নয়, সর্বদা মা যেন আমাদের হৃদয়ে থাকে, মা দিবসে এই প্রত্যাশা।
চাইনা কোন মা অবহেলিত হয়ে থাকুক। চাইনা এ পৃথিবীতে আর কোন বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠুক। চাইনা কোন মা, বাবা পরিবারের অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হোক। চাই পরিবারের সকলের ভালোবাসায় সিক্ত হোক পৃথিবীর সকল মা, বাবা। পৃথিবীর সব মায়ের জন্য রইল ঐকান্তিক ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক-এডভোকেট সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও সংগঠক

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.