শিক্ষকের ভূমিকায় পুলিশ কর্মকর্তা!

0

এম আনোয়ার হোসেন:: পুলিশ। নাম শুনলে ভীতি বিরাজ করে আমাদের সমাজে। কিন্তু ব্যতিক্রমও রয়েছে। এবার পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গেল শিক্ষকের ভূমিকায়। চক ও ডাস্টার হাতে কালো ব্লাক বোর্ডে চক্রবৃদ্ধির হারের একটি অংকের প্রশ্ন লিখেন তিনি। তারপর শিক্ষার্থীদের তাদের খাতায় নোট করার জন্য বলেন এবং সমাধানের পুরো প্রক্রিয়া তিনিই নিজেই খন্ডখন্ড করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। গণিতভীতি কাটিয়ে তুলতে গণিত অংক কষা। এরপর ইংরেজি একটি বাক্য লিখে তার কোন শব্দটি কি তাও বুঝিয়ে দিলেন তিনি। এবং সেই বাক্যটির যে সঠিক অনুবাদ বলতে যে শিক্ষার্থী সক্ষম হন তাকে করা হয় পুরুস্কৃত। ভবিষ্যত জীবন কোন জিনিসটি মেনে গড়ে তুলবে তার উপর দেওয়া হচ্ছে গাইডলাইন। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সুষম খাওয়ার ডিম, দুধ খাওয়ার পরামর্শ। নিজের জীবনকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধুর আতœজীবনী বই উপহার এবং তার জীবন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরছেন। আমৃত্যু অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত না করা, সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য উদ্ধুদ্ধও করার পাশাপাশি গানও শোনান তিনি। এইভাবে একটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে অদূর ভবিষ্যত কেমন গাইডলাইন মেনে চললে সুন্দরভাবে সাজানো যাবে তার উপর ৫০ মিনিটের ক্লাশে নিচ্ছেন মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মশিয়ার রহমান।

গত ১৩ মে মিরসরাইয়ের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নিয়ে তিনি এই অভিনব ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগের শুভ সূচনা করেন। পরদিন ১৪ মে উপজেলার খৈয়াছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেরীর শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নেন তিনি। তিনি সর্বশেষ রোল যার তাকে প্রথম বেঞ্চে বসান এবং তাকে পুরস্কৃত করেন পড়াশোনায় উৎসাহি করতে। তার উক্তি, সবাইতো ফাস্ট বয়কে পুরস্কার দেয়, লাস্টকে কেউ গুরুত্ব দেয় না।

সেদিন বেলা ১১ টায় দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের গণিত ক্লাশ নেওয়ার কথা ছিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেনের। তার পরিবর্তে পুলিশ কর্তকর্তা মশিয়ার রহমানকে দেখে শিক্ষার্থীরা চমকে যান। তিনি বলে উঠেন, আমি পুলিশ নয় আমি তোমাদের বড় ভাইয়ের মতো, আমাকে ভাই বলে ডাকো। আমার কাছে তোমাদের যেকোন সমস্যার কথা বলতে পারো। পুলিশকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সৎ ও ন্যায়ের পথে থাকলে তোমাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। পড়াশোনায় কঠোর পরিশ্রম করলে জিপিএ-৫ পাওয়া কোন ব্যাপার না, তার জন্য তোমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সঠিকভাবে গাইডলাইন মেনে চলতে হবে।

খৈয়াছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল শাহরিয়া, সানজিদ মাহমুদ ইভান, হালিমাতুছ সাদিয়া, তাসনিয়া ইজদানী বলেন, ‘পুলিশ স্যারের বুঝানোর ধরন অসাধারণ। ৫০ মিনিটের ক্লাশটি আমরা খুব উপভোগ করেছি। আমরা চাই মাঝেমাঝে তিনি এমন আমাদের আরো ক্লাশ নেবেন। উনার প্রতিটি কথা মনযোগ দিয়ে শুনেছি, তা আমাদের জীবন চলার পথে কাজে লাগবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘মিরসরাই সার্কেলের এএসপি মশিয়ার রহমান সাহেবের এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। উনার ২ টি ক্লাশ দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বুঝানোর কৌশল আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। উনি পুলিশে চাকুরি না করে শিক্ষকতা করলে আরো ভালো করতে পারতেন বলে আমি মনে করি। আমি উনাকে অনুরোধ করেছি আমাদের অভিভাবক সমাবেশে তিনি যেন যোগ দেন এবং অভিভাবকদের উদ্দেশ্যেও উনি মূল্যবান কিছু পরামর্শ দেবেন। তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মেলবন্ধনের পাশাপাশি আরো তৎপরতা বেড়ে যাবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে।’

খৈয়াছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন জানান, ‘আমি এটিকে মহৎ উদ্যোগ হিসেবে দেখছি। পুলিশ কর্মকর্তারা সবসময় ব্যস্ত থাকেন তারমধ্যেও তিনি এইভাবে সময় দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উদ্ধুদ্ধ করছেন। নিঃসন্দেহে বড় মনের মানুষ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে উপলব্দি করার এটি একটি অনন্য উদাহরণ।’

মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মশিয়ার রহমান বলেন, ‘সরকারি চাকুরি করি, সরকারের টাকায় আমাদের সবকিছু। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে বোনের পড়াশোনার খবর নিই, তাদের স্কুলে যাই; শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করি। এখানে কর্মস্থলেতো আমার বোন বা ভাই কেউ নেই। ওই শিক্ষার্থীরা আমার ভাই-বোন, তাদের পড়াশোনায় একটু দেখভাল করলে হয়তো তারা ভালো ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে এমন উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে উপজেলার ২ টি বিদ্যালয়ে ক্লাশ নিয়েছি। আমি মনে করি আমার কথাগুলো শিক্ষার্থীরা তাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণ ও অনুকরণ করলে তারা সফলতা লাভ করবে। ক্রমান্বয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলোতেও ক্লাশ নেবো।’

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.