রাইফার হত্যাঃ চিকিৎসকদের আস্ফালন
জুবায়ের সিদ্দিকীঃ বাসার ড্রয়িং রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেলনা নিয়ে একদিন আগেও হেসেখেলে মেতে ছিল ছোট রাফিদা খান রাইফা। গলায় ব্যথা অনুভব করে সে হঠাৎ। গায়ে জ্বরও ছিল হালকা। দেরি না করে গত ২৯ জুন বৃহস্পতিবার বিকেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর অভিজাত বেসরকারী হাসপাতাল ম্যাক্সে।
আশা ছিল সঠিক চিকিৎসা নিয়েই ঘরে ফিরবে সে আবার। একদিন পর ফিরল, তবে সুস্থ হয়ে নয়। লাশ হয়ে। এন্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগের পর ব্যথায় ছটফট করতে থাকা রাইফাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। সেই ওষুধই তাকে পাড়িয়ে দিল চিরদিনের ঘুম। ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় ৩০ ঘন্টার মধ্যেই লাশ হলো আড়াই বছরের রাইফা। তার বাবা দৈনিক সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর ষ্টাফ রিপোর্টার রুবেল খান। একমাত্র শিশু সন্তান রাফিদা ছিল রুবেলের সংসারের সব হাসিখুশি।
এক দিনের মধ্যে রুবেলের রঙ্গিন সবস্বপ্ন যেন অমানিশার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। কেউ যেন অদৃশ্য হাতে তার হৃদয়পটের সব রঙ্গিন চিত্রগুলো মুছে দিচ্ছে। কেন মানুষের সাজানো স্বপ্নগুলো এভাবে মুছে যায়? রাফিদা নামের ছোট কুডিটি জন্মের পর, তার তো ফুল হয়ে ফোটার কথা, বাতাসে সুরভি ছড়ার কথা? কিন্তু কেন অকালে সকাল ঝরে যায়?
ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগে সাংবাদিক নেতাদের দাবির মুখে ম্যাক্স হাসপাতালের এক চিকিৎসক, এক নার্স ও হাসপাতাল সুপারভাইজারকে চকবাজার থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারন সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে।একজন নিস্পাপ শিশুর চিকিৎসার অবহেলায় মৃত্যুতে কোন ধরনের অনুশোচনাতো দুরের কথা, কেন হাসপাতাল থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসককে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে-কৈফিয়ত চান ওসির কাছে।
ওসির সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন তিনি। এক ঘন্টার মধ্যে চট্টগ্রামের সব হাসপাতাল বন্ধ ও সাংবাদিকদের চিকিৎসা সেবা না দেওয়ার হুমকি দিয়ে ক্ষমতা দেখাতে থাকেন তিনি। সাংবাদিকরা তখন কঠোর অবস্থান নিলে এক পর্যায়ে সুর নরম হয় তার। পরে দুই পক্ষের আলোচনায় সিদ্ধান্ত অনুসারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
পাঁচ সদস্যের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। আলোচনার ভিত্ত্বিতেই আটক চিকিৎসকসহ তিন জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে অভিযুক্ত চিকিৎসককে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। সাংবাদিক রুবেল খান ও তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেছেন, শিশু রাইফা গলার ব্যথা অনুভব করায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যাওয়ার দুই ঘন্টা পরও কোন চিকিৎসকের দেখা পাননি তারা।
এক পর্যায়ে হাসপাতালটির কেবিনে ভর্তি করানো হয় তাকে। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক এলে কথা বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিধান রায় চৌধুরীকে ডাকা হয়। কিন্তু তিনি তাৎক্ষনিক হাসপাতালে না এসে টেলিফোনে ডিউটি চিকিৎসককে চিকিৎসার পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ডা. বিধানকে ডাকা হলেও তিনি রোগী দেখতে আসেন পরদিন শুক্রবার দুপুরে। এ
র মধ্যে তার পরামর্শ অনুযায়ী শিশু রাইফাকে যে এন্টিবায়টিক দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োগের পর তার শরীরে প্রচন্ড খিচুনিসহ গুরুতর পার্শ¦ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চিকিৎসকদের বিষয়টি বারবার জানানোর পরও ওষুধ অপরিবর্তিত রাখেন তিনি। শুক্রবার রাতে একই এন্টিবায়োটিক দেওয়ার পর খিঁচুনি এতই বেড়েছিল যে, তার দাঁত ভেঙ্গে মুখ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি টেলিফোনে চিকিৎসককে জানানো হলে তিনি রোগী না দেখেই সেডিল সাপোজিটর প্রয়োগ করতে বলেন।
কর্তব্যরত চিকিৎসক দেবাশীষও মাত্রা না দেখেই তা প্রয়োগ করতে বলেন নার্সকে। এটি দেওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রাইফা। একমাত্র সন্তানকে অকালে হারিয়ে রুবেলের পরিবার বাকরুদ্ধ হয়ে যান। স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে ভারী হয় হাসপাতাল এলাকা। পথচারী থেকে সাংবাদিক সমাজের সবাই কেঁদেছে অঝোর নয়নে।
নির্মম এই অবহেলা জনিত মৃত্যুর ঘটনায় সামান্য দু:খ প্রকাশ করে সমবেদনা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি চিকিৎসকরা। ডাক্তার নামের কষাইগুলো কেড়ে নিয়েছে অনুজ সাংবাদিক রুবেল খানের একমাত্র সন্তানকে। তার সন্তান রাইফার মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতৃবৃৃন্দ ও সর্বস্তরের সাংবাদিকরা ম্যাক্স হাসপাতালে ছুটে যান। তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালের অভিযুক্ত চিকিৎসকসহ ৩ জনকে থানায় সোপর্দ করা হয়। এ নিয়ে ওসির সঙ্গে আলোচনা করছিলেন সাংবাদিক নেতারা।
তখনই হন্তদন্ত হয়ে ওসির রুমে ঢুকে অসৌজন্য ও আপত্তিকর আচরন করেন বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান। পরদিন হয়রত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার শরিফ মসজিদে রাইফার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপি-জামাত মালিকানাধীন ম্যাক্স হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গলাকাটা টাকা আদায় করে সেবা না দেওয়া, অবহেলা, খারাপ ব্যবহার ও ভুল চিকিৎসার মত একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। এই ম্যাক্স হাসপাতালের লাইসেন্স ত্রুটিপূর্ন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল-ক্লিনিক) প্রফেসর ডাঃ কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। গত ১ জুন রুবেল খানের কন্যা রাইফার তদন্তে এসে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, পুর্নাঙ্গ লাইসেন্স নেই ম্যাক্স হাসপাতালের।
তারা সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। এটা সম্পুর্ন অবৈধ। এর আগে মৃত্যুর কারণ তদন্তে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের গঠিত তিন সদস্যের টিম এই দিন পৌঁছায়। এ সময় তদন্ত কমিটির সদস্য, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সাংবাদিক নেতারা বৈঠকে বসেন। এতে সাংবাদিক নেতাদের কথা বলতে বাঁধা দেন বিএমএ নেতা ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেয়াকত আলী খান। যে কারনে সাংবাদিক নেতারা ক্ষুদ্ধ হয়ে বৈঠক বর্জন করেন। এর পর সাংবাদিকরা এক ঘন্টা অবস্থান কর্মসুচী পালন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। ম্যাক্স হাসপাতাল ভবনটি তৈরীতে অনুসরন হয়নি সিডিএর নকশা।
অনুমতি না নিয়ে বসানো হয়েছে লিফট। এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় কোন আইনকানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি। রুবেল খানের কন্যার মৃত্যুতে সরাসরি দায়ী ডা. বিধান রায় চৌধুরী ও ডা. দেবাশীষকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। সর্বত্র হস্তক্ষেপ করছে বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারন সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল। চমেক হাসপাতালের ডাক্তার না হয়েও তিনি মেডিকেলের বদলী বানিজ্য, টেন্ডার ও ঠিকাদারী ব্যবসা সব নিয়ন্ত্রন করেন। ডা. মিজানসহ ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামী হিসেবে হাসপাতালে উত্থান হওয়া ডা. ফয়সালের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
চিকিৎসা সেবা না দিয়ে চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতা হিসেবে দুর্নীতি, অনিয়ম, পোষ্টিং বানিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ডা. ফয়সাল ইকবাল বিপুল পরিমাণ বিত্ত বৈভবের মালিকও হয়েছেন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের মৃত নুরুল আবছার চৌধুরীর পুত্র ডা. ফয়সাল ইকবাল ১৯৯২ সালে চমেক ছাত্র সংসদের ভিপি থাকা অবস্থায় হত্যা মামলার আসামী হন। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় মিজান নামে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার ছাড়াও বোরহান উদ্দিন ও ফরিদ নামে হাসপাতালে আসা রোগীর দুই স্বজনের করুন মৃত্যু হয়। এই মামলায় ডা. ফয়সাল ইকবাল ছিলেন অন্যতম আসামী। এর পর ভারতে পালিয়ে যান তিনি। পরবর্তীকালে দেশে আসলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বেশ কিছুদিন জেল খাটার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। স্বাক্ষীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর কারনে তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ডা. ফয়সাল ইকবাল খালাস পায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে ডাক্তার থেকে কর্মচারী সবার বদলী ও পদায়ন তার নিয়ন্ত্রনে। তাকে ম্যানেজ না করলে তিনি চিকিৎসকদের হয়রানী করেন এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া চমেক হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার খাবার সরবরাহ, আউট সোর্সিং ব্যবসা সহ বিভিন্ন সরবরাহ কাছের টেন্ডারও নিয়ন্ত্রন করেন ডা. ফয়সাল। বর্তমান সরকারের প্রথম আমল থেকে মেডিকেলে ডা. ফয়সালের আধিপত্য চলছে। নিজে সরকার সমর্থক সংগঠনের নেতা পরিচয় দিলেও ওঠাবসা ও সুসম্পর্ক বিএনপি-জামাতের সঙ্গে।
নিজ এলাকা রাঙ্গুনিয়ার মানুষও তাকে ভাল চোখে দেখেন না। রুবেল খানের একমাত্র শিশু কন্যার অকাল মৃত্যুতে ডা. বিধান রায় চৌধুরী ও ডা. দেবাশীষকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন সিইউজে, বিএফইউজে ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব নেতৃবৃন্দ।
একই সঙ্গে তাদের আশ্রয়দাতা, সাংবাদিক ও পুলিশের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহারকারী কথিত বিএমএ নেতা, ট্রিপল মার্ডারসহ বহু অপকর্মের নায়ক ডা. ফয়সালকেও গ্রেফতারের দাবী উঠেছে। তার অবৈধ অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ দুদকসহ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন। এ ঘটনায় সুষ্ট তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সাংবাদিক সমাজ কঠোর কর্মসুচী ঘোষনা করবে বলে জানায়। এদিকে কতিপয় ডাক্তাররা মিটিং করে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন।