উল্টো পথে সরকার

0

জুবায়ের সিদ্দিকী

সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে দ্বিতীয়বার গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সম্পুর্ন অযৌক্তিক ভাবে সাধারন মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সরকারের কাজ করার কথা থাকলেও বর্তমান সরকার হাঁটছে উল্টোপথে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে। যেখানে উৎপাদন খরচ কমায় বিদ্যুতের দাম কমার কথা। কিন্তু দাম বাড়িয়ে সরকার সাধারন মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলেছে। এতে করে অর্থনৈতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোন যুক্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের দাম কমেছে অথচ বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যুক্তিই দেখাতে পারছে না সরকার। অন্যদিকে তেলের দাম কমানোর কথা। সরকার যদি তেলের দাম কমায়ও পরিবহন ভাড়াতো কমাতে পারবে না।

ফলে তেলের দাম কমালেও তার সুফল পাবে না সাধারন মানুষ। সচেতন মহল বলেন, সরকার হাটছে তার উল্টেপথে। যে কোন পন্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই পন্যের দাম বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমলে দাম বাড়ে তাই আমরা এখন দেখছি! বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে। কিন্তু দাম বাড়ানো হলো। উৎপাদন খরচ কমার কারনে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দেয়া উচিত ছিল সরকারের। এ অবস্থায় বাড়ানোর কোন যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হবে। যে দামে গ্রাহকরা গ্যাস কেনে তাতেই বিতরন কোম্পানীগুলো লাভ করেছে।

এ অবস্থায় কোন যুক্তিতে সরকার দাম বাড়ালো? গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বর্ধিত মুল্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা করার কথা। সেই টাকা দিয়ে গ্যাস খাতের উন্নয়নের কাজে লাগানোর কথা। কিন্তু‘ তহবিলের টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে তার কোন নিয়ন্ত্রন নেই। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন ব্যয়ও এখন বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান। গ্রাহক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়নি সরকার। ইতিপুর্বে যে বেশ কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়নো হয়েছিল তার পেছনে কিছুটা যুক্তি ছিল। কারন দেশে মোট বিদ্যুতের সাড়ে তিন ভাগের এক ভাগ উৎপাদিত হয় জ্বালানী তেল ভিত্ত্বিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল উদ্ধমুখী এবং বাড়তে বাড়তে তা ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। ফলে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের ব্যয়ও অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

জরুরী ভিত্ত্বিতে বিদ্যুতের চাহিদা পুরনের জন্য সে সময় সরকারকে তিন চারগুন দাম দিয়ে এই বিদ্যুৎ কিনতে হয়েছে। দাম বাড়িয়ে সরকার সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে তেলের দাম আন্তর্জাতিক ভাবে কমতে কমতে ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলার নেমে গেছে। কমেছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও। তাহলে এখন কেন সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল? গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে প্রথমত দুর্ভোগে পড়বে জনগন। কারন এর ফলে পরিবারে ব্যবহার্য গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও বাড়বে দ্রব্যমুল্য ও পরিবহন ব্যয়।

এর চাপ পড়বে সীমিত আয়ের মানুষের উপর। গ্যাস বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পক্ষে যারা নতুন পে-স্কেল তথা বেতন বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছেন তারা শুধু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর কথা মাথায় রেখেই এ ধরনের যক্তি তুলে ধরছেন। যারা সরকারী কর্মচারী নয়, দেশের বিপুল সংখ্যাঘরিষ্ট সেই মানুষের কথা ভাবলে এ ধরনের বক্তব্য কেউ দিতে পারতেন না। সবায় জানে, প্রতিটি সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সহ সুযোগ সুবিধা বাড়ায় আস্থার জন্য। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা ও বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনীতিতে।

দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল নয়। রপ্তানী আয়ের মন্দা চলছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে উদ্যোক্তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এর আগে গত মেয়াদের শুরুতে ২০০৯ সালের আগষ্ট মাসে সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। ২০১১ সালে শুধু সিএনজির দাম বাড়ানো হয়। এর পর বর্তমান মেয়াদের প্রথম তিন মাসের মাথায় ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুতের পাইকারী ও খুচরা দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় গ্রাহক পর্যায়ে ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।

তবে এবার বিদ্যুতের প্রান্তিক গ্রাহক পর্যায়ের দাম বাড়ানো হয়নি। বরং গ্রাম পর্যায়ে কম বিদ্যুত ব্যবহারকারীদের দাম কিছুটা কমেছে। রেগুলেটরী কমিশনের হঠাৎ গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে দেশব্যাপী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিারজ করছে। সিএনজির দাম বাড়ানোতে পরিবহন খরচও বাড়বে। গনপরিবহনে নৈরাজ্যও দেখা দিতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে অবশ্যই এর দায় বহন করতে হবে সাধারন মানুষকে। সরকার ভালভাবেই জানেন, পে-স্কেলের সুবিধা পাবে দেশের ১৮ লাখ সরকারী কর্মচারী, এর মধ্যে বেসরকারী স্কুল কলেজের এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের জন্য এটি কার্যকর হলে ২১ লাখে ঠেকতে পারে। যা হয়তো এক কোটি মানুষের আয় বৃদিধ পেতে পারে। কিন্তু বাকি ১৫ কোটি মানুষ গ্যাস বিদ্যুতের বাড়তি দামের আয় কিভাবে করবেন? দেশের নিত্যপন্যের আকাশচুম্বি দাম বৃদ্ধির ফলে এমনিতেই দেশের সাধারন মানুষের মধ্যে নাভি:শ্বাস উঠেছে।

উপরন্ত গ্যাস বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ’মরার উপর খারার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে নিশ্চিতভাবে। আমরা সাধারন জনগন সরকারের কাছে এই বিষয়টি আরো ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা এবং পুন:বিবেচনার জন্য প্রত্যাশা করছি।
এমনিতেই চট্টগ্রামবাসী বৃষ্টিতে এবং জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস করছে। যানজনে নাকাল নগরবাসী। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য প্রতিদিন শুধু বাড়ছে। দুর্মুল্যের এই বাজারে সাধারন মানুষের উপর গ্যাস বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধি একটি উদ্বেগের কারন হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটও নগরজবীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। বাজারে সবজী, মাছ, মসলা থেকে শুরু করে এখন থেকে হু-হু করে বেড়ে চলেছে। পিয়াজের দাম ইতিমধ্যে চারগুন বেড়েছে। বাজারে সরকারের কোন মনিটরিং নেই।

যার যেভাবে খুশি দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। যারা বেসরকারী প্রতিষ্টানে চাকরী করেন তাদের বেতন বাড়েনি। এ খাতে বেতন বাড়ানোর কোন নিয়মও নেই। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে গ্যাস বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধির কারনে। এর প্রভাব কি সাধারন মানুষের সংসারে এসে পড়বে না? এ সংখ্যার মানুষের পিঠ কি দেওয়ালে গিয়ে ঠেকবে? সরকার কি সাধারন মানুষের কথা চিন্তা করবেন না? আমরা কি এই সরকারকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসাইনি? সাধারন মানুষের উপর এই খড়গকেন নেমে আসবে।
অন্যদিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের গার্মেন্টস শিল্প। রপ্তানীমুখী তৈরী পোশাক কারখানা মালিকরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধি দেশে তৈরী পোশাকের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এমনিতেই বহি:বিশ্বে বানিজ্যের নয়া মেরুকরনের ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রপ্তানীর প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। সরকার এইভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সাধারন মানুষ ভালভাবে না নিলেও সরকারী দল আওয়ামী লীগ জনগনের কষ্ট অনুভবকরতে পারছে না। কারন দল ক্ষমতায়।

এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা মুখে কুলুপ দিলেও দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক। বেফাঁস কথা বলে এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই সভা, সেমিনারে বিষয়টি সম্পুর্নভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনগনের ম্যান্ডেট খুবই শক্তিশালী। গনমানুষের কষ্টের কথা যদি সরকার আন্তরিকভাবে না দেখে উল্টোপথে চলেন তবে জনগনও একদিন শক্ত জবাব দেবে।

অন্যায় ও অযৌক্তিক ভাবে গ্যাসের গ্যাস বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধি কোনভাবেই সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা এই গনতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের সরকার জনগনের মনের ভাষা বুঝতে সক্ষম হবে। এটিই হবে জনগনের জন্য মঙ্গল।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.