পর্যায়ক্রমে সব রোহিঙ্গা কোরবানির মাংস পাচ্ছে

0

শহিদুলইসলাম, উখিয়া :: কেমন ছিল আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এক বৎসরের জীবন-যাপন। গত বছরের কোরবানির সময়টা প্রাণ বাঁচাতে কেটেছে বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, ধানক্ষেত ও নদীর জল সাঁতরিয়ে। কোনমতে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এসে জড়ো হয়ে আকুতি ছিল নিরাপদ আশ্রয়ের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের দারিদ্রতার মাঝেও লাখ লাখ শংকটাপন্ন মানুষকে মানবিক আশ্রয় দেন। এর মাঝে কেটে গেছে একটি বছর। এবারের কোরবানির ঈদে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারো কারো মুখে আনন্দের হাসি ফুটলেও ওপারে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মাঝে বিরাজ করছিল শোকের মাতম। তবে ছোটদের ঈদ কেটেছে খেলাধুলায়, আনন্দ-উল্লাসে।

পর্যায়ক্রমে সব রোহিঙ্গা কোরবানির মাংস পাচ্ছে

উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত ৩০ ক্যাম্পের প্রায় ৮ লাখ নতুন, পুরোনো সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা মিলে ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ রোহিঙ্গা ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করেছে।

নিজ দেশ মিয়ানমারে বহুমুখী নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে রোহিঙ্গারা বুধবার শরণার্থী শিবিরের ১২৬৫ মসজিদ ও ৫৬০টি মক্তবে ঈদের নামাজ আদায়ের পর চোখের জলে হারানো স্বজনদের স্মরণ করেছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইমাম ও মুসল্লিরা। মোনাজাতে অংশ নেয়া লাখো রোহিঙ্গা মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবাসন কামনা করে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন।

গত বছর এই দিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপরে দেশটির সেনাবাহিনী বর্বর নির্যাতন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে পালাতে থাকেন। এভাবে পালাতে গিয়ে অনেকে হারিয়েছেন বাবা-মা ও কাছের স্বজনদের। অনেক নারী হয়েছেন ধর্ষণের শিকার। সর্বস্ব হারানো এসব রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সাড়ে ৫ হাজার একর বনভুমি।

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ঈদের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত করেছেন যেন তারা নিরাপদে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে পারেন। শংকটাপন্ন মুহুর্তে বিশাল জনগোষ্টিকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের জন্যও দোয়া করেছেন তারা।

কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রফিক উল্লাহ বলেন, আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে বাংলাদেশের হুকুমত। তাই মোনাজাতে নিজ দেশে নিরাপদে ফিরতে এবং বাংলাদেশের জন্যও দোয়া করেছি আমরা।

তিনি বলেন, আরাকানে আমরা নানা স্বজনকে হারিয়েছি। পুরো ১ বছর হতে চলেছে বাংলাদেশে আশ্রিত জীবনের। কিন্তু এখনো আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশার আলো দেখছি না।

লম্বাশিয়া ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নারী রকিমা খাতুন বলেন, এখানে সার্বিক দিক দিয়ে ভালো থাকলেও আজকের ঈদুল আযহায় ফেলে আসা গত এক বছরের স্মৃতি তাদের শোকবিহ্বল করে তুলেছে।

পাশের আরেক ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি রহমত উল্লাহ বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের নামাজ আদায় করতে পারিনি। আজকের এই দিনে আমরা ছিলাম রাখাইনের একটি পাহাড়ি জঙ্গলে। এবার বাংলাদেশে অন্তত ভালো করে ঈদের নামাজটি আদায় করতে পেরেছি।

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত হাজেরা বেগম ঈদও কেটেছে স্বজন হাজানোর যন্ত্রণায়। তবে রাখাইনের বর্মী সৈনিকের দেওয়া আগুনে বা গুলিতে নয়; অনিরাপদ মাতৃভূমি ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে সাগরে নৌকা ডুবিতে এক পুত্র সন্তান মারা যায়।

রোহিঙ্গা এই নারী বলেন, স্বামী দু’বছর আগে মিয়ানমারে মারা যায়। রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসার পথে নৌকাডুবিতে এক পুত্র সন্তান মারা যায়। আজ ঈদের দিন গর্ভের সন্তানের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে।

বয়োবৃদ্ধরা মনোকষ্ট নিয়ে থাকলেও ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য গত ঈদুল ফিতরের মতো আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। নাগরদোলা, রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বৈশাখী মেলার আদলে আয়োজন করে স্থানীয় কিছু মানুষ। নতুন জামা পড়ে সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আনন্দে মেতেছিল শিশু-কিশোররা।

এ প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক আশ্রয় দিয়েছেন। শুরু থেকে সরকার এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাদের সব ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে। গত ঈদের মতো এবারও কোরবানির ঈদে ৩ হাজার গরু ৬শ ছাগল এবং এনজিওদের ১০ হাজার প্যাকেটজাত মাংস, রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব রোহিঙ্গাদের কোরবানির মাংস দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফিরতে ইচ্ছুক। উপরের নির্দেশনা পেলে আমরা মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করব।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ১হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচটি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি মসজিদ ও ২০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব মসজিদ ও নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গারা।

সর্বশেষ এ প্রসঙ্গে জানার জন্য রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: আবুল কালামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে নতুন করে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা । এর আগে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরো সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা। যুগের পর যুগ বংশ পরম্পরায় তারা রাখাইনে বাস করলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করেনি। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতায় ভোগে রোহিঙ্গারা। কখনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরংয়ের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। এভাবে তারা রূপান্তরিত হয়েছে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে। তাই মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশায় রয়েছে এসব নিপীড়িত বিশাল এই জনগোষ্টি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.