অনেক সময় কষ্টে কাঁদতেন রমা দিদি !

0

বিশ্বজিৎ পাল, সিটি নিউজ: সকাল ৪টা ২০ মিনিট। মোবাইলটা বেজে উঠে। রিসিভ করতেই দেখি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে আলা উদ্দিন খোকন জানালেন রমা দিদি আর নেই। যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দীর্ঘদিনের পাশে থাকা শ্রদ্ধার মানুষটি এভাবে আমাদের একা ফেলে চলে যাবে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।

তবে বাস্তবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেকদিন পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন একাত্তরের বীরাঙ্গনা, মুক্তিযুদ্ধের ঝাপটায় ঘরবাড়ি, নিজের সৃষ্টি সর্বোপরি তিন’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত জীবনসংগ্রামী ‘একাত্তরের জননী’ রমা চৌধুরী। বার্ধ্যক্যের ভারে নুয়ে পড়া শরীরে প্রাণঘ্যাতি রোগের সীমাহীন যন্ত্রনায় অনেক সময় কষ্টে কাঁদতেন, আমাদেরও কাঁদাতেন।

শান্তনা দিতেন দীর্ঘ ২২ বছরের উপরে রমা চৌধুরীর একান্ত সহকারী হিসেবে সুখে দুখে নিজেকে জড়িয়ে রাখা আলাউদ্দিন খোকন। আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস করতেন। এভাবে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ভালো হওয়ার, আর এক একটা রোগ তাঁর জমে থাকা স্বপ্নগুলো চুরমার করে দিত। হাসপাতালে আসার আগ থেকে স্বতন্ত্রবোধ ও আত্মমর্যাদাশীল রমা চৌধুরী নিজের লেখা বই বিক্রি করেই সংসার চালাতেন। সুস্থ জীবনে স্নেহের আঁচলে জড়িয়ে রাখা শ্রদ্ধেয় রমা চৌধুুরী ভালো থাকুন পরাপরে।


চট্টগ্রামে দুর্ভাগা এক নারীর নাম ‘রমা চৌধুরী’। যিনি একাত্তরে হারিয়েছেন সম্ভ্রম, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে হারিয়েছেন তিন ছেলে (প্রথম দুই ছেলে মারা যায় শ্বাসকষ্টে, আরেক ছেলে মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়)। তাঁর সারাটা জীবনই কেটেছে দারিদ্র্যতার সঙ্গে সংগ্রাম করে। এতকিছুর পরও একাত্তরের এই বীরাঙ্গনা জীবন কাটিয়েছেন বীর দর্পে। সন্তান হারানোর তীব্র যন্ত্রণা আর সীমাহীন দারিদ্রতা সঙ্গী করে কেটেছে তাঁর সংগ্রামী জীবন। জীবনের কঠিন সংগ্রামে কখনো কোনো সহায়তা নেননি। এমনকি সরকার নিজ থেকে এগিয়ে এলেও বিনয়চিত্তে তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এক সময় নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর ফের জুতো পড়া ছেড়ে দেন। জুতো ছাড়াই ১৬ বছর ধরে পথ চলেছিলেন রমা।

অবসরে তাঁর (রমা) মুখ থেকে শুনেছি, ১৯৪১ সালে বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রামে রমা চৌধুরীর জন্ম। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করা রমা দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। উত্তাল একাত্তরের ১৩ মে ভোরে নিজ বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসরদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রমা চৌধুরী।

সম্ভ্রম হারানো রমা কোনোরকমে প্রাণে বেঁচেছিলেন পুকুরে নেমে। তবে হানাদাররা গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘর। এরপরও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি রমা চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবে চলে তাঁর জীবন। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেন। কোনোরকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজের লেখা বই প্রকাশ করে তা ফেরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ১৯টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

গতবছরের ২৩ ডিসেম্বর পড়ে গিয়ে কোমরে ফ্রাকচার হয়েছিল। সেদিনই আলাউদ্দিন খোকন, তাঁর জহর চৌধুরীসহ আমরা সকলে মিলে রমা চৌধুরীকে ভর্তি করাই মেডিকেল সেন্টারে।

এরপর ১৭ জানুয়ারি তাঁকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকলে কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। ডিসচার্জ দিলে ২৬ মার্চ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীতে। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর রক্তবমি হলে ফের ভর্তি করা হয় চমেক হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তাঁকে দূরে নেওয়া যাবে না। নগরেই রাখতে হবে রমা চৌধুরীকে। আবার ফিরে আসেন চট্টগ্রামের মোমিন রোডস্থ চেরাগী পাহাড় লুসাই ভবনের চতুর্থ তলার ছোট্ট কুটিরে। এখান থেকে আবার কয়েকদিন পর হাসপাতালেন ভর্তি করা হয়। এই লুসাই ভবনে দীর্ঘ ৮ বছরের উপরে রমা চৌধুরীকে নিয়ে আমার পথ চলা। কত জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন রমা চৌধুরীর কাছে। খুব কাছ থেকে দেখেছি রমা চৌধুরীকে কেমনভাবে মানুষ ভালোবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন। মৃত্যুর সংবাদে লুসাই ভবনের সেই কুটিরে রমা চৌধুরীর পোষা ৫টি বিড়ালও বোবা কান্নায় ফেটে যাচ্ছে।

রমা চৌধুরীকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই এই বীরাঙ্গনাকে গণভবনে ডেকে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বীরঙ্গনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর কি প্রয়োজন? উত্তরে রমা শুধু বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শুধু আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে দেন। আমার আর কিছু প্রয়োজন নেই। জীবনে কখনো কোনো আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেননি রমা চৌধুরী। এমনকি নেননি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও। আজীবন মাথা উঁচু করে বাঁচা এই বীর আমাদের এতিম করে চলে গেলেন, রেখে গেলেন স্মৃতির অফুরন্ত ভান্ডার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৫ আগষ্ট সন্ধ্যায় আইসিইউ’তে স্থানান্তর করা হয়। তিনি শ্বাসকষ্ট সহ নানা রোগে ভুগছেন।

ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী রমা চৌধুরীকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি রমা চৌধুরীকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি দেখা করে রমা চৌধুরীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে বলেন। পরে চিকিৎসকরা বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা চালান। পাশাপাশি রমা চৌধুরীর সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের থাকার জন্য হাসপাতালের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর কেবিনটি বরাদ্দ করা করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ভোর চারটায় তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখা এ মহিয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

উল্লেখ্য,লেখার বিষয়: অদ্য ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোর চারটায় না ফেরার দেশে চলে যাওয়া দীর্ঘদিন এক সাথে পথ চলার শ্রদ্ধার মানুষ, একাত্তরের বীরাঙ্গনা, মুক্তিযুদ্ধের ঝাপটায় ঘরবাড়ি, নিজের সৃষ্টি সর্বোপরি তিন’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত জীবনসংগ্রামী ‘একাত্তরের জননী’ রমা চৌধুরীকে নিয়ে লেখাটি প্রকাশ করলাম ৩ সেপ্টেম্বর সোমবার ২০১৮, সময়: ৫টা ৭ মিনিট।

লেখক- সাংবাদিক বিশ্বজিৎ পাল, ৫/এ মোমিন রোড, লুসাই ভবন(৪র্থ তলা),কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।
মোবাইলঃ ০১৬৭৭-২০৯২৬৬ , ই-মেইল- [email protected]

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.