চট্টগ্রামে অস্ত্রধারীদের খুঁজছে পুলিশ

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ  আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য সংঘাত ও সহিংসতা ঠেকাতে চট্টগ্রাম নগর ও জেলা পুলিশ সাড়ে তিন হাজার অবৈধ অস্ত্রধারীর তালিকা তৈরীর পর তাদের ধরতে মাঠে নেমেছে। বিশেষ করে তফসিল ঘোষনার পর থেকেই এ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে বলে দাবী পুলিশের।

নির্বাচনের আগে পুলিশের তৈরী করা এ তালিকার নাম থাকা আর না থাকা নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক থাকলেও শান্তিপুর্ন পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করতে অবৈধ অস্ত্রধারী গ্রেফতার এবং তাদের হেফাজতে থাকা অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এমনকি এসব অবৈধ অস্ত্রধারী নির্বাচনে সংঘাত, সহিংসতা সৃষ্টির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও পক্ষের হয়ে কোন ভাড়ায় খাটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।

জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে গত অক্টোবরেই নগর ও জেলা পুলিশ চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ৩ হাজার অবৈধ অস্ত্রধারীর তালিকা তৈরীর কাজ সম্পন্ন করে। এর মধ্যে সিএমপির তৈরী করা তালিকায় নগরীর ১৬ থানায় দুই হাজার এবং জেলার আওতাধীন ১৬ থানায় দেড় হাজার অবৈধ অস্ত্রধারীর নাম উঠে আসে।

এর পর গত ১৫ অক্টোবর সার্কিট হাউসে অনুষ্টিত বিভাগীয় আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান এ ব্যাপারে উপস্থিত জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে সকলকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশ দেন। এই সভায় পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সীমান্ত ও পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে স্থল ও সাগরপথে অস্ত্রের চালান আসতে পারে উল্লেখ করে পুলিশ সুপারদের (এসপি) সতর্ক করেন।

এসময় এসপিদেরকে স্ব-স্ব এলাকায় নজরদারী ও নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। সিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবর রহমান তফসিল ঘোষনার পর অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন.’ নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সময়ে যাকে কেউ সহিংসতা কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

তাই শান্তিপুর্ন নির্বাচনের পরিবেশের জন্য উপযোগী করে আমরা নিরপত্তা পরিকল্পনা প্রনয়ন করেছি। ঝুকিপুর্ন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারী, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারেও পুলিশ সদস্যরা মাঠে কাজ করছে। পুলিশ সুত্র জানায়,’ নির্বাচনের দিনক্ষন ঘনিয়ে আসার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে অবৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকা তৈরীর কাজ শেষ করে জেলা ও নগর পুলিশ।

আসন্ন সংসদ নির্বাচন শান্তিপুর্ন পরিবেশে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারেও তালিকা প্রনয়ন করা হয়। এসব অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসলে নির্বাচনে পেশীশক্তির প্রয়োগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন।

নতুন এ তালিকায় নগরীতে দুই হাজার এবং জেলা পুলিশের আওতাধীন ১৬টি থানায় অন্তত দেড় হাজার অবৈধ অস্ত্রধারীর নাম উঠে আসে। এ ছাড়া বাঁশখালী, সন্দ্বীপ ও মহেশখালীতে অস্ত্র তৈরীর কারখানা থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকা তৈরীর ক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তৎপরতার বিষয়টি গুরত্ব দেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।

জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন,’ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের অনুসারীসহ সাধারন ভোটারদের নিরাপত্তার ওপর হুমকি আসতে পারে। এমনকি এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর অক্রমনও করতে পারে। এসব বিষয় আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। তফসিল ঘোষনার পর নিরাপত্তা জোরদার ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে অভিযানও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আমরা নিরাপত্তায় কমবেশী ঝুকি রয়েছে এমন এলাকাগুলোর ওপর অধিক নজর রাখছি।

অপরধার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে সংঘটিত খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ উঠতি বয়সীদের মধ্যে অপরাধ বৃদ্ধির প্রমান পায়। পাড়া মহল্লায় পুরনো সম্প্রাজ্যে ফিরে আসা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অনেকে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান নেওয়ার পর এলাকায় উঠতি বয়সীদের নিয়ে বাহিনী সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট বড় ভাইদের প্রশ্রয় উঠতি বয়সীদের বিপদগামী হওয়ার পথ সুগম করে।

আর বড় ভাইরা এলাকভিত্তিক অধিপত্য বিস্তার, চাঁদা বা তোলাবাজি ও মাদক ব্যবসা সহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে তাদেরকে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া উঠতি বয়সীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দেয়ায় তারা চোখের পলকেই বিপদগামী হচ্ছে। কথায় কথায় কিংবা তুচ্ছ ঘটনায় অস্ত্র হাতে দেখা মিলছে কিশোরদের। বিদেশী পিস্তল, রিভলবার, এসবিবিএল গানের পাশাপাশি দেশে তৈরী এলজিও তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে।

কিশোরদের হিরোইজমের বশে কিংবা নিজের ভেতরে বিবেচনাবোধ তৈরী হওয়ার আগেই অবৈধ পেয়ে খুন, রাহাজানি ও ছিণতাইয়ের মত গুরুতর অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তারা। মাদক ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার ও টেন্ডার সন্ত্রাসেও এসব তরুনদের ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পদ পদবী না থাকলেও ছাত্র সংগঠনের নাম গায়ে মেছে অপরাধে জড়িয়েছে এক শ্রেনীর কিশোর ও তরুনরা।

সচেতন নাগরিক সমাজের মতে,’ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার অনেক অগে থেকে অবৈধ অস্ত্রের বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন ছিল। দেশে নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের নেতিবাচক সংস্কৃতি চর্চা রয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসলেই কালো টাকার লেনদেন ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের কদর বেড়ে যায়। নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী থেকে শুরু করে প্রার্থীদের অনেকে ফলাফল নিজের পক্ষে আনতে নানা ছলছাতুরীর আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ অবৈধ অস্ত্রধারীদের ভাড়া করে বলেও প্রচার রয়েছে।

বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। জননিরাপত্তা ও শান্তিপুর্ন পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করার পুর্বশর্তই হল বৈধ অস্ত্র থানায় জমা নেয়ার পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করা। যদিও সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনের আগে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। এটাও চরম উদ্বেগের বিষয়।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের মোট ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে নগর পুলিশের (সিএমপি) আওতায় চারটি এবং জেলা পুলিশের আওতাধীন রয়েছে ১২টি নির্বাচনী এলাকা। এসব আসনে সবমিলিয়ে ভোটার রয়েছে ৫৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬৩জন। আর ভোট কেন্দ্র রয়েছে ২ হাজার ৮৯৮টি। ইসির ঘোষিত পুন:তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহন অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.