কোথায় কার কাছে বিচার পাবো জানি নাঃ বিমল শীলের ক্ষোভ

বাঁশখালীর চাঞ্চল্যকর ১১ হত্যা

0

দিলীপ তালুকদারঃ দেশের ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক ও নৃশংস ১১ হত্যার ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন কূল কিনারা হয়নি এ মামলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর শীলপাড়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এই ঘটনায় ৪ দিনের শিশু কার্তিককেসহ ১১জনকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা। হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হাই কমিশন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে আসলেও এখন কেউ খবর রাখে না বলে অভিযোগ খোদ মামলার বাদী বিমল শীলের।

এদিকে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার অগ্রগতি ও অবস্থান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩ এ গত ১৫ বছরে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। গত এক বছরে মাত্র দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বছরের পর শুধু তারিখ পড়েছে। মামলার এই দশা জানিয়ে বিমল শীল বলেন, ‘কিভাবে বিচারের আশা করতে পারি! দিন যতই যাচ্ছে সংশয় বাড়ছে। কোথায় কার কাছে গেলে বিচার পাব জানি না।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১০ সালে সিআইডি দপ্তর চট্টগ্রাম হতে এই মামলায় ৩৮ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে আদালতে। অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণের পর শুনানী শেষে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এরই মধ্যে মামলার প্রধান আসামী ও এ হত্যা ঘটনার মূল হোতা বিএনপি নেতা ও সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাতো ভাই আমিনুর রহমান চৌধুরী উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেন। যা এখনো পর্যন্ত কোন ধরনের সুরাহা হয়নি।

এদিকে ওই নেতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম আদালতে ধীরগতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাদী বিমল শীল। তাছাড়া প্রথম দিকে এই মামলা নিয়ে চলে বহু রকম তালবাহানা একে একে অভিযোগপত্র বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করা হয় আসামীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে। সর্বশেষ এই মামলায় ৩৮ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি অভিযোগপত্র দিলেও বিভিন্ন মহলের তদবিরে নজরুল ইসলাম নামে এক আসামীকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এই মামলা থেকে।

এই মামলা নিয়ে হরেক রকম তালবাহানা চললেও ১১ হত্যার বিচার নিয়ে আদৌ হাল ছাড়েননি মামলার বাদী। বিমল শীল বলেন, ঘটনার দিন রাতে দরজায় তালা দিয়ে ঘরে আগুন দিয়ে তার বাবা তেজেন্দ্র লাল শীল, মাতা বকুল শীল, ভাই অনিল শীল, বৌদি স্মৃতি শীল, ভাতিজি রুমি শীল, সোনিয়া শীল এবং একমাত্র ভাতিজা চার দিন বয়সী কার্তিক শীল, কাকাতো বোন বাবুটি শীল, প্রসাদি শীল, এনি শীল এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা মেসো দেবেন্দ্র শীলকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

পল্লী চিকিৎসক বিমল শীল সেদিন ঘরের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পর থেকে তিনি ভিটে বাড়ী ছেড়ে শহরে বসবাস করছেন। ভিটেটি শুধু পড়ে রয়েছে। নিহতদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের ঘটনার বিচার না হওয়ায় আতংকে বসবাস করছেন তারা। আবার কখন কি হয় সে আতংকে ভুগছেন তারা।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক একভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, দেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও হত্যার বিচার হচ্ছে না। এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি বলেন, বিচার না হওয়ায় সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তা ও আস্থাহীণতায় ভুগছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।

বাঁশখালী ঘটনার বিচার না হওয়ার দায়ভার রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা দরকার। বর্তমানে মামলাটি তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মুন্সী আব্দুল মজিদের আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহন চলছে। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও একজন সাক্ষীও হাজির হননি। পরে আদালত আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারী পরবর্তী দিন ধার্য করেন।

প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর গভীর রাতে বাঁশখালীর সাধনপুরের শীল পাড়ার তেজেন্দ্র শীলের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করে। পরে ওই ঘটনায় পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য চিকিৎসক বিমল চন্দ্র শীল বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির নেতা আমিনুর রহমান জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।

কিন্তু তৎকালীন সরকারের সময়ে তদন্তে পুলিশ তাঁকে অভিযুক্ত করা থেকে বিরত থাকে বলে বাদীপক্ষ বারবার অভিযোগ করেন। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাতকানিয়া সার্কেলের তত্কালীন এএসপি ক্লারেন্স গোমেজ ২০০৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমিন চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে ৩১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এর বিরুদ্ধে মামলার বাদী বিমল শীলের নারাজির পর আদালত ২০০৭ সালের ২০ মার্চ মামলাটি অধিকতর তদন্ত্রে নির্দেশ দেন। এরপর বারবার তদন্তে আমিন চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। প্রতিবারই বাদী তার বিরোধিতা করে আদালতে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে আমিন চেয়ারম্যানের নাম উঠে আসে। এই মামলায় তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.