পাহাড়তলীতে মহিউদ্দিন মার্ডারের নেপথ্যে

0

দিলীপ তালুকদারঃ নগরীর ডবলমুরিং থানার পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে গণপিটুনি দিয়ে মো. মহিউদ্দিন সোহেল (৩৯) নামে স্থানীয় এক ঠিকাদারকে হত্যা করা হয়েছে। সোহেলের পরিবার অভিযোগ করে বলেন, সোহেলকে স্থানীয় কাউন্সিলর সাবের ও সাবেক জামাত নেতা ওসমান খানেরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। সোহেলের আত্মীয়-স্বজনদেরও দাবি, চাঁদাবাজি নয় বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বলি হয়েছে সে। নিহত সোহেল দক্ষিণ খুলশী এলাকার আবদুল বারিকের ছেলে। তিনি একজন রেলওয়ের কর্মকর্তা। এছাড়া গণপিটুনিতে সোহেলের সহযোগী রাসেলও আহত হয়।

গত ৭ জানুয়ারী সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের দু’জনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠায়। এসময় কর্তব্যরত চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে সোহেলকে মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরে বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন পুলিশ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, মহিউদ্দিন সোহেল নিজেকে কখনো মন্ত্রীর কখনো আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী বলে পরিচয় দিত। এছাড়া প্রভাব খাটিয়ে বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করত।

অন্য একটি সূত্র জানায় সাবেক জামাত নেতা বর্তমানে স্থানীয় জাতীয় পার্টি নেতা ওসমান খানের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অনৈতিক ব্যবসার আখড়া ভেঙ্গে দিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর জন্য জানাযার নামাজের মাঠ নির্মাণ করে দেন সোহেল। সোমবারের ঘটনার আগে বাজারের ব্যবসায়ী জাতীয় পার্টির নেতা ওসমান খান ও সোহেলের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। সোহেলের অনুসারীরা ওসমান খানের ওপর হামলা করে বলে জানায়। এতে ওসমান খানের মাথা ফেটে যায়। এ ঘটনার পর ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে সোহেলের কার্যালয় ঘেরাও করে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারের ব্যবসায়ীরা সোহেলকে ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এলাকার আর একটি সূত্র জানায়, বর্তমান কাউন্সিলরের আগামীর পথ পরিস্কার করতে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির আহ্বায়ক ও ১২নং সরাইপাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাবের আহমদ সওদাগর বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মহিউদ্দিন সোহেল রেলওয়ের জায়গায় অফিস বানিয়ে সেটি মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছিল। সেখানে সে মাদক বেচাকেনা ও সেবন করত। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে নিয়মিত চাঁদা দাবি করত। আমাদের এক ব্যবসায়ী ওসমান খানের সাথে তার এক সপ্তাহ ধরে সমস্যা চলছিল। সে তাঁর কাছেও চাঁদা দাবি করেছে বলে আমি শুনেছি। এই ঘটনার সূত্র ধরে সোমবার ওসমান খান তার অফিসে গেলে তার লোকজন ওসমানের মাথা ফাটিয়ে দেয়। তখন ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা তাকে ধরে গণপিটুনি দেয়।

এদিকে নিহত মহিউদ্দিন সোহেলের ভগ্নিপতি বলেন, সোহেল অত্যন্ত একজন ভালো ছেলে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের বলি হয়েছে সে। তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবসায়ী চাঁদা দাবির অভিযোগ করেননি। তিনি আরো বলেন, সোহেল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সাবেক সহ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্বাহী সংসদের সাবেক উপশিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক এবং সরকারি কমার্স কলেজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিল। এছাড়া সে একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল কমিটিরও একজন সক্রিয় সদস্য ছিল। সে পাহাড়তলী বাজারকে সিসি ক্যামেরার আওতাধীন করা, মাদকমুক্ত এলাকা গড়া, রাতের বেলায় পুরো পাম্প হাউস কলোনিতে রাস্তাসমূহ আলোকিত রাখার উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি ফ্রি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প, গ্রন্থাগার ও মিলনায়তন করার উদ্যোগ নিয়েছিল বলে দাবি করেন নিহত সোহেলের ভগ্নিপতি।
তিনি আরো জানান, ঘটনার আগের দিনও এলাকাবাসীদের একটি উঠান বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিল সোহেল।

এদিকে মহিউদ্দিন সোহেলকে হত্যার ঘটনা তুলে ধরতে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব মিলনায়তরে সোহেলের পরিবারের পক্ষ থেকে এক সাংবাদিক সম্মেললে আয়োজন করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে মহিউদ্দিন সোহেলের ভাই মো. শফিকুল ইসলাম শিশির কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, পাহাড়তলী বাজার ও আশেপাশের এলাকাকে সিসি ক্যামেরার আওতাধীন করার উদ্যেগ, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত এলাকা করার ঘোষনা এবং কার্যক্রম শুরু, রাতের বেলায় পাম্প হাউজ কলোনীর রাস্তাসমূহ আলোকিত করাসহ স্থানীয় এলাকাবাসী ও বিশেষ করে বস্তিবাসীর জন্য ফ্রি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প, গ্রন্থাগার ও মিলনায়তন করার উদ্যেগ নেয়াই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাই কোন ছিচকে সন্ত্রাসী কিংবা কখনোই চাঁদাবাজ ছিলেন না। তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং তাঁর সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল এবং আমার ভাই বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার ছিলেন।

শিশির বলেন, আমার ভাই সোহেল দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতি এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতির পাশাপাশি একজন স্বনামধন্য ঠিকাদার ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং দীর্ঘদিন তিনি ঢাকায় অবস্থানের পর গত বছর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তাঁর অভিভাবক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র আলহাজ্ব আ জ ম নাসির উদ্দিনের পরামর্শে তাঁর জন্মস্থান পাহাড়তলীকে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত করার সংগ্রামের প্রথম কাজ হিসেবে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দিশারী ক্লাবকে পুনরায় সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় কয়েকটি মাদকের আখড়া ভেঙ্গে দেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় কাউন্সিলর সাবের সওদাগরের নেতৃত্বে কর্তত্বে ও সাবেক জামাত নেতা বর্তমানে স্থানীয় জাতীয় পার্টি নেতা ওসমান খানের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অনৈতিক ব্যবসার আখড়া ভেঙ্গে দিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর জন্য জানাযার নামাজের মাঠ নির্মাণ করে দেন। এমনতর আরো অনেক জনহিতকর উদ্যেগের ফলশ্রুতিতে স্থানীয় ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ী এবং অনৈতিক ব্যবসায়ীদের রোষানলে পড়েন।

তিনি বলেন আমার ভাই মহিউদ্দিন সোহেলের নামে থানায় কোন মামলাতো দুরের কথা একটা জিডি পর্যন্ত নেই। সেই মহিউদ্দিন সোহেলকে পরিকল্পিতভাবে এক শ্রেনীর ঘৃণ্য নরপশুরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। তাকে চাঁদাবাজ তকমা দিয়ে তার সারাজীবনের শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। আমাদের দুঃখ, সেই ঘৃণ্য মানুষগুলোর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন আমাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধু। তাদের প্রতি আমাদের কোন অভিযোগ নেই। শুধু জিজ্ঞাসা, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে যেকোন সচেতন নাগরিক যেকোন অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। জিডি করেন, মামলা করেন। অথচ তার নামে কিছু না থাকার পরও কতিপয় সাংবাদিকের ভাষায় চাঁদাবাজ মহিউদ্দিন সোহেল গণপিটুনিতে নিহত হয়। একজন সাংবাদিকের মনেও কি এই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেনি যে গণপিটুনিতে নিহত মহিউদ্দিন সোহেলের গায়ে ২৬টি ছুরির আঘাত কেন?

সাংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভাইকে ফিরে পাব না। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এতটুকু প্রত্যাশা করতে পারি না। কান্না করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে করজোরে মিনতি করে শিশির বলেন, অনুগ্রহ করে আমার ভাইয়ের নামে চাঁদাবাজ লিখবেন না। আমার ভাই হত্যার সুষ্ট তদন্ত হোক এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করার পর চাঁদাবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস যারা চালিয়েছেন তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সোহেলের স্ত্রী নিগার সোলতানা, তার বারো মাসের শিশু সন্তান, তিন বছর বয়সী ছেলে ফায়েজ তাজোয়ার মাসরিক, বাবা আব্দুল বারি, মা ফিরোজা বেগম, বোন রাজিয়া সুলতানা, একাত্তরের ঘাতক দালার নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত বাঙালি প্রমুখ। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার পরিবারে পক্ষ থেকে কোন মামলা করা হয়নি। তবে মামলা করা হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.