চট্টগ্রামে বন্দরের জায়গায় মৎস্য কেন্দ্র !
জুবায়ের সিদ্দিকীঃ কর্ণফুলী নদীকে দখলমুক্ত করতে অবশেষে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। নানা জটিলতা, হুমকি ও বাধা উপেক্ষা করে কর্ণফুলীর তীর ধরে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পুর্ব ঘোষনা অনুযায়ী সকাল ১০টায় সদরঘাটের লাইটার জেটি এলাকায় শরু হয় এই উচ্ছেদ কার্যক্রম। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট তাহমিলুর রহমান ও তওহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রথম দিনেই সরকারী দুটি বুলডোজার দিয়ে গুডিয়ে দেওয়া হয় ৫০টি অবৈধ স্থাপনা।
সেখানে ছিল ছোট-বড় বসত ঘর সহ প্রভাবশালীদের কয়েকটি বহুতল ভবন। এ সময় ৩ তলা বিশিষ্ট একটি মাছের কোল্ড স্টোরেজ নিয়ে সংশয় তৈরী হয় উপস্থিত লোকজনের মাঝে। কোল্ড স্টোরেজটির মালিক হুমায়ুন চৌধুরী উপস্থিত থাকলেও তার ভবনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি স্থান ত্যাগ করেন।
এর পর উচ্ছেদকারী দল পৌঁছায় নদীর তীর অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠা কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স নামক বহুতল ভবনের সামনে। ভবনটির দুটি দেওয়াল ভেঙ্গে দেওয়া হয়। প্রভাবশালী শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার মো: রশিদের মালিকানাধীন এ কর্নফুলী শিপ বিল্ডার্স প্রতিষ্টানটিতেও উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রশাসন। ভাঙ্গা হয়নি প্রতিষ্টানটিতে প্রশাসনের পুর্বে লাল দিয়ে যাওয়া অংশ পর্যন্ত। উচ্ছেদ কার্যক্রমের সমন্বয়ক মো: তাহমিলুর রহমান বলেন,’ কর্নফুলী নদীকে দখলমুক্ত করার এ অভিযানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম ধাপে কর্নফুলীর ১০ একর জায়গা দখলমুক্ত করার অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রথম দিনেই ৫০টি অবৈধ স্থাপনা গুডিয়ে দিয়ে ৪ একর জায়গা দখলমুক্ত করা হয়। উচ্ছেদ কার্যক্রমে আসেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো: ইলিয়াস হোসেন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (ইঞ্জিনিয়ার) কমোডর কে.এইচ আক্তার হোসেন। জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন,’ আর এস মোতাবেক সব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। সরকার এ বিষয়ে একদম কঠোর। আমরা জেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে থাকব অনড়।
এ সময় কর্নফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড নিয়ে তিনি বলেন,’ আর.এস অংশ যদি এই প্রতিষ্টানটির মুল ভবনের ভিতরে পড়ে, তবে তা উদ্ধার করতে প্রয়োজনে ভবন ভেঙ্গে দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (ইঞ্জিনিয়ার) কমোডর কে.এইচ আক্তার হোসেন জানান,’ কর্নফুলী নদী দখল মুক্ত হলে বন্দরে অনেক জাহাজ ভিড়তে পারবে। জাহাজের নাবিকরা নদীর পাশে বসতে পারবে। যা হবে দৃষ্টিনন্দন। এ ছাড়া জাহাজের মালামাল উঠানামা করতে সহজ হবে।
কর্নফুলীকে বাঁচাতে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযানে জেলা প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। উচ্ছেদ অভিযানে জেলা প্রশাসন সহ সর্বমোট ১০টি সংস্থা কাজ করছে। সংস্থাগুলো হলো, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিএ, বিদ্যুৎ বিভাগ, কর্নফুলী গ্যাস, টিএন্ডটি ও পরিবেশ। এ ছাড়াও নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। এ ছাড়া রয়েছেন চট্টগ্রাম ভুমি অফিসের বিভিন্ন সার্কেলের সার্ভেয়ার ও কানুগোরা।
দ্বিতীয় দিনের মত অভিযানে লবনপট্টির ৩০টি অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয় উচ্ছেদকারী দল। যার মধ্যে ছিল দাদা সল্ট, কর্নফুলী সল্ট, পপুলার সল্ট, সুমন সল্ট, বিবি ট্রেডার্স, আরাফাত অয়েল, জাহিদুল কবির অয়েল ও সাগর অয়েল কারখানা। এ অভিযানে একটি খাল উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগেই ৪০টি অবৈধ স্থাপনা মালিকরা নিজেরাই সরিয়ে নিয়েছেন।
কাকে হুমকি দিচ্ছে? কে হুমকি দিচ্ছে? হুমকি দিয়ে কেউ পার পাবে? কেউ পার পাবে না। আমাদের ইন্টেলিজেন্টস টিম এখন অনেক শক্তিশালী। ট্রেক করা এখন আর কোন ব্যাপার না। আগের বাংলাদেশ নেই। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। কর্নফুলীর উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তাকে কেউ হুমকি দিলে ট্রেক করে হুমকিদাতাদের ধরা হবে বলে জানান ভুমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। উচ্ছেদ কার্যক্রমের এক পর্যায়ে পরিদর্শনে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন,’ ৫ দিনে আমরা ১০ একর জায়গা উদ্ধার করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে কর্নফুলীর পাড় দখল করে গড়ে উঠা সেই আলোচিত কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স নিয়ে মন্ত্রী বলেন, উচ্ছেদের শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কর্নফুলী শিপ বিল্ডার্স। বভনটির ভাঙ্গা না ভাঙ্গা নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। প্রাথমিক ভাবে ভবনটি না ভাঙ্গার কারন হলো, ভবনটিতে একটি কোল্ড ষ্টোরেজ আছে। সেখানে কয়েক লক্ষ টন মাছ মজুদ আছে কোম্পানীটির। এই মাছ আমাদের দেশের সম্পদ। পাবলিসিটির জন্য ধুমধাম ভবন ভেঙ্গে দেশের সম্পদ নষ্ট করা যাবে না। তবে আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে চাই, এই ভবনটিও উচ্ছেদের হাত থেকে রেহায় পাবে না। আমরা তাদের দ্রুত মাছগুলো সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।
কয়েকদিনের মধ্যে সময়ও বেঁধে দেব ভবন ভাঙার বিষয়ে। উদ্ধার হওয়া জায়গা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন,’ আমরা এই নদীর পাড়কে নান্দনিকতার ছোঁয়া দিতে চাই। তবে প্রাথমিক ভাবে এই পাড়ে কার্গোর জন্য পল্টন জেটি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কেননা আমাদের দেশে বিদেশ থেকে আসা জাহাজগুলো কার্গো জটের কারনে ভিড়তে পারে না। যার জন্য প্রতিটি জাহাজ প্রতি সরকারকে জরিমানা গুনতে হয় ২০ থেকে ২৫ ডলার। এই জেটিটি নির্মান করা সম্ভব হলে অনেক টাকা লোকসানের হাত থেকে বাঁচবে দেশ’। হাইকোর্টের আদেশের পর কর্নফুলীকে দখলমুক্ত করতে ৪ দিনে ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা গুডিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
ঝুঁপড়ি ঘর থেকে বহুতল ভবন গুডিয়ে দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে ৭ একর জায়গা। পতেঙ্গা ভুমি অফিসের সহকারী কমিশনার তাহমিলুর রহমান ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো: তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০ সংস্থার উচ্ছেদকারী দলটি সদরঘাটের লাইটার জেটি এলাকায় প্রথম উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। প্রথম দিনই ৮০টি অবৈধ স্থাপনা গুডিয়ে দিয়ে ৪ একর জায়গা উদ্ধার করে উচ্ছেদকারী দলটি। দ্বিতীয় দিনে মাঝিরঘাটের লবনপট্টিতে অভিযান চালিয়ে ৩০টি অবৈধ স্থাপনা ও তৃতীয় দিনে মাঝির ঘাটের হাবিব গলিতে উচ্ছেদ চালিয়ে ৪০টি অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়।
এদিকে কর্নফুলী তীরের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানের ধারাবাহিকতায় আতঙ্কে আছেন খাস জমিতে গড়ে উঠা মৎস্য অবতরনকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা। রাজাখালী ও চাক্তাই খালের কিনারায় আইন-কানুন ও সমালোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এ মৎস্য অবতরনকেন্দ্র নির্মান করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জায়গা ব্যবহারের জন্য ইজারা নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে মৎস্য অবতরনকেন্দ্র নির্মান করা হয়। এতে ১৮৮টি দোকান নির্মান করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি দোকান ১০-১৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সুত্রে প্রকাশ, সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষ মৎস্য অবতরনকেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের তাদের স্থাপনা সরানোর নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি প্রদান করেছিল। ওই চিঠিতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়। কর্নফুলী নদীর তীরে মৎস্য অবতরনকেন্দ্র নির্মানের শুরুতে জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিশাল এলাকাজুড়ে মৎস্যকেন্দ্র নির্মান করা হয়েছে।
২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে নদীর সীমানা নির্ধারন, দখল, ভরাট ও নদীতে যে কোন ধরনের স্থাপনা নির্মান বন্ধ রাখার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। মানবাদিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জনস্বার্থে এ রিট দাখিল করেছিলেন।
রিটের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগষ্ট কর্নফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা অপসারনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই ভাবে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের তীরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ নিয়েও পৃথক রিট পিটিশন দাখিল করেছেন তিনি। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৫ বছরের ইজারা নিয়েছে বাংলাদেশ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি:।
চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী এক লাখ ৭৩ হাজার ২৬৩ বর্গফুট জায়গা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে বছরে ২৮ লাখ ১৫,৫২৩টাকা হারে ইজারা দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের ইজারা প্রাপ্ত মৎস্য অবতরন কেন্দ্রটি যদি ভেঙ্গে গুডিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের কি হবে? বন্দর কি অন্যত্র পুনর্বাসন করবেন?