আজাদীর ক্রাউন : প্রফেসর খালেদের স্বাধীনতা পদক

0

মোস্তফা কামাল পাশা : পছন্দের চাকরি ও প্রথম বস অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। চট্টগ্রামের ব্রান্ড দৈনিক আজাদীতে ১৬ বছরের সাংবাদিকতার সুবাদে আজ প্রাপ্তি অনেক। সবচে’ বড় প্রাপ্তি আত্মবিশ্বাস। সম্পাদক প্রফেসর মোঃ খালেদের সাথে সম্পর্কের রসায়ন “তেতো-মিষ্টির ককটেল”! অপ্রিয় সত্য চর্চায় কোন রাখঢাক নেই আমার। শিখিয়েছেন মরহুম বাপজান।

প্রফেসর সাহেবকে একজন টিপিক্যাল সম্পাদক বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন নিবেদিত সংবাদ কর্মী। ডেস্কে বসে রাত জেগে কাজ করতেন, আমাদের সাথে। আবার দিনে সম্পাদকীয় লিখছেন। নিভাঁজ সফেদ পাজামা,পান্জাবি, চামড়ার কাল চকচকে স্যান্ডেল তাঁর নিজস্ব অপূর্ব ব্রান্ড। রিক্সা প্রিয় বাহন।

তাঁর জানি দোস্ত আজাদীর বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধর। দু’জনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সর্বস্ব ত্যাগী সৈনিক! রাজনীতি তথা গণ মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন দু’জনে। বিনিময়ে প্রফেসর সাহেব পেয়েছেন অনেক মর্যাদাপূর্ণ পদ। ‘৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে হাটহাজারী-রাউজান আসনে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন মুসলিম লীগের সবচে’ নামীদামি “মাষ্টারমাইন্ড” ফজলুল কাদের চৌধুরীকে।

শুধু চট্টগ্রাম বা দেশের পূর্বাঞ্চল নয় তদানীন্তন পাকিস্তানের ডাকসাইটে মুসলিম লীগ নেতা ফ কা চৌধুরীর পতন ছিল অবিশ্বাস্য! সন্ত্রাসের সুনামি তুলেও ফ কা চৌধুরীর নির্বাচনী পতন ঠেকানো যায়নি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন তিনি। মুজিব নগর সরকারের তথ্য মন্ত্রক,স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও জয় বাংলা পত্রিকা সম্পাদনায় যোগ্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ‘৭৫ সালের জানুয়ারিতে ‘বাকশাল’ নামে দ্বিতীয় বিপ্লবের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন ঘোষণার পর প্রফেসর খালেদকে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের গবর্নরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন।

‘ ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শাহাদাতের পর কঠিন সময় পার করেন তিনিসহ দলের শীর্ষ নেতা-কর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর পর তিনি রাজনীতি থেকে নিজকে অনেকটা গুটিয়ে নেন। কিন্তু আমাদের সাথে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পরে উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য পদে ছিলেন। সক্রীয়তা না থাকলেও দলের একাডেমিক আলোচনায় নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। তাঁর চমৎকার বক্তব্য এবং শুদ্ধ রাজনৈতিক অভিযাত্রার পথ নির্দেশনায় নির্মেদ যুক্তি ছিল কর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস।

আগাগোড়া রাজনৈতিক ঘরাণার হয়েও প্রফেসর খালেদ সম্পাদক হিসাবে কখনো সাংবাদিকতাকে রাজনীতির সাথে গুলিয়ে ফেলেন নি। এটাই তাঁর স্বচ্ছ ও পেশাদারিত্বের বড় গুণ। পত্রিকা অফিসে তিনি শতভাগ সাংবাদিক। বস্তুনিষ্ঠতা এবং সংবাদ মূল্যই তাঁর সাংবাদিকতার মূল দর্শন। কিন্তু আজাদীর সম্পাদকীয় নীতি কখনো মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক দর্শন থেকে একচুলও হেলেনি। এটাই আজাদীর বিশেষত্ব। বহুমত ও পথের সেবা দিলেও সম্পাদকীয় নীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিরাপোষ। সমকালীন সাংবাদিকতায় এটা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

আমার নিজের সমস্যা, জেদ এবং অনিয়ম। যা তিনি একদম সহ্য করতেন না। অফিস সূচি অনুসরণ ১৬ বছরের চাকরি জীবনে কখনো হয়ে উঠেনি। অনিয়ম সত্বেও আমার প্রশ্রয়ের নিশ্চিদ্র ঠিকানা ছিলেন বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধর। সাধন স্যার পুত্রের মতো আগলে রাখতেন। ভিতরে রাগ থাকলেও বন্ধুর সৌজন্যে আমাকে প্রচুর ছাড় দিয়েছেন প্রফেসর স্যার। প্রশ্রয়ের কারন হচ্ছে, কাজে গতি এবং দ্রুততম সময়ে যে কোন সাবজেক্টের উপর আইটেম তৈরির যোগ্যতা।

এরশাদ আমলে রাজনীতি শূন্যতায় নিউজ খরা ছিল তীব্র। খরা সামলানোর দায় সাধন স্যার আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। ফলে পরিবেশনা কৌশলে নয়া নয়া মাত্রা যোগের পরিক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়ে যাই। পত্রিকার প্রতি পৃষ্ঠা ও বিভাগে ছিল আমার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। মোট কথা, সাধন বাবুর প্রশ্রয়ে হাতুড়ে ‘অলরাউন্ডার’ হয়ে যাই। নিজেও নানা উপলক্ষে বিশেষ করে প্রতি বছর রমজান ও শরৎ ঋতুতে প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ আঙ্গিকের ভিন্ন স্বাদের কলামও উপহার দিতে থাকি নিয়মিত ।

রিপোর্টিং,ফিচার, সাহিত্য, ছোটদের পাতা, খেলাধূলাও বাদ যায়নি। এত স্বাধীনতা ও সুযোগ না পেলে ‘৯৭ সালের মাঝামাঝিতে আজাদী ছেড়ে আসার পর টানা ২২ বছর সাংবাদিকতা পেশায় সক্রিয় থাকা কখনো সহজ হতোনা। তাও স্ব-চাকুরিতে। জানতাম, আজাদীর স্বাধীনতা অন্য কোন মিডিয়া আমাকে দেবেনা। তাই অন্য কোন ছাদের নিচে মাথা গলানোর চিন্তা ছেটে ফেলি।

আজাদীর অর্জিত শিক্ষা টানা চর্চা করে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার পথ নিজে তৈরি করে নিয়েছি। প্রচুর ভাঙচুর, ক্ষতি, ধাক্কা,হোঁচট খেলেও থামাথামি বলতে কোন শব্দ জীবনে নেই। অন্যজনে যাই বলুক, পেশায় আমি শতভাগ সফল মনে করি। লোভ, লাভের চাহিদা কম বলে সাংবাদিকতার মাত্রা ভাঙার কাজ এখনো সমানে চালিয়ে নিচ্ছি, বাংলা-ইংরেজি দু’ভাষাতেই। নিজের অবস্থান তৈরির জন্য সাধন স্যারের চে’ও বেশি ঋণী প্রফেসর স্যারের কাছে। তাঁর তীক্ষ্ণ নজরদারি না থাকলে সাধন স্যারের প্রশ্রয় কোন কাজেই আসতোনা। লেখার গুণগত মান ধারালো করতে না পারলে আজাদীতে এত পরিক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ কী কখনো পেতাম? প্রফেসর সাহেব আমার কাজে খুঁৎ পাননি বলেই অসাধ্য সম্ভব হয়েছে।

খুশির উর্ধচাপে আজকের অকথিত এই জবানবন্দি! প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এবার পাচ্ছেন সেরা রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক। এরচে’ বড় খুশির খবর আর কী হতে পারে! অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। যাহোক, Better late then never. ইন্জিনিয়ার আবদুল খালেকও রাষ্ট্রীয় পদকের হকদার। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু তাঁর কর্ম ও কীর্তি এ’ জনপদের জন্য তুলনাহীন। তিনি আজাদী জন্ম দিয়েই অমরত্বের চৌকাঠ পার হয়ে গেছেন। কীর্তির মুকুটে আছে আরো পালক! কোহিনূর লাইব্রেরি, কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস, সাপ্তাহিক কোহিনূরের প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

“কাঁদতে আসিনি- ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” ৫২এর ভাষা শহীদের উপর তৎক্ষনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচিত প্রতিবাদী কবিতাটি প্রকাশের অদম্য সাহস দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর ছবি দেখেছি আজাদী ডেস্কের দেয়ালে। ছোট ছবি। অপূর্ব জ্যোতি ঠিকরে বেরোয় তাঁর চেহারায়।

আশ্চর্য স্নিগ্ধ পবিত্র দ্যূতি! শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! তাঁকেও মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হলে পদকের গৌরবই বাড়বে। কীর্তির লগ্নে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের প্রতি হার্দিক অভিনন্দন ও আজাদী প্রতিষ্ঠাতা ইন্জিনিয়ার আবদুল খালেকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সেই সাথে আজাদীর সুযোগ্য সম্পাদক এম এ মালেকসহ পুরো আজাদী পরিবারকেও অভিনন্দন ।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.