চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্র্যাকডাউন

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রামে ক্রমাগত বেড়ে অপরাধের ঘটনা। বাসাবাড়িতে চুরি, রাস্তা-ঘাটে ছিনতাই, যানবাহনে পকেটকাটা যাচ্ছে মানুষের। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে উদ্বেগজনকভাবে। পুলিশের অভিযানের সাথে অপরাধীরা পাল্টাচ্ছে অপরাধের ধরন। অপরাধী তালিকায় যুক্ত হয়েছে কিশোররা। গড়ে উঠেছে নানা রকম প্রতারক চক্র। সরল মানুষকে জিম্মি করে এরা টাকা আদায় করতে সিদ্ধহস্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,’ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও কিশোর অপরাধীদের দাপট।

জানা গেছে, চলতি বছলের শুরুতে প্রথম দুই মাসের মধ্যে শুধু জানুয়ারীতেই নগরীতে ৬৭৮টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। নগরীর ১৬টি থানায় এসব অভিযোগ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এতে খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক, অপহরন, চোরাচালান, মারামারি সহ নানা অপরাধের ঘটনা আছে। এর বাইরেও রয়েছে নানা অপরাধের ঘটনা। বিভিন্ন কারণে যেগুলো থানায় অভিযোগ হিসেবে আসছে না। অপরাধ প্রবনতা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সিএমপি’র একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

একই সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আত্বহত্যার ঘটনাও। কোন কোন ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুন ও আত্বহননের ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক অস্থিরতা, একাকীত্ব, হতাশাসহ নানা কারনে এসব অপরাধের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পারিবারিক বন্ধ আরও দৃঢ করা এবং সংস্কৃতি চর্চার উপর জোর দেন তারা। পুলিশের তথ্য মতে, চলতি বছর জানুয়ারীতে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সিএমপিতে ৬৭৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালানে ৪৮৮টি, নারী ও শিশু নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ১২৫টি ঘটনা রয়েছে। ফেব্রুয়ারী থেকে চলতি মার্চ মাসের এই পর্যন্ত ১৬ থানায় ঘটেছে স্পর্শকাতর হত্যাকান্ড ও আত্বহত্যার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচলাইশ থানার আতুরার ডিপো এলাকায় অভিামান করে জেসমিন আক্তার নামে পঞ্চম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রীর আত্বহত্যা। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নফুলী থানায় কৃষি জমি থেকে খুলশী থানাধীন লালখান বাজারের বাসিন্দা আলমগীর হোসেনের লাশ পাওয়া যায়। পাহাড়তলী থানাধীন একে খান এলাকায় স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে সকালে একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার পর দুপুরে স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

একই থানায় দেবরের হাতে খুন হয় ভাবী। আকবর শাহ থানাধীন বেলতলী এলাকায় রেলের জায়গা দখল নিয়ে বিরোধের এক পর্যায়ে মোহাম্মদ মাসুদ নামে যুবলীগকর্মী খুন হন। বন্দরথানাধীন নিমতলা এলাকায় স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার এক পর্যায়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আঁখি আক্তার সুলতানা নামে এক গৃহবধু আত্মহত্যা করে। পাঁচলাইশে একটি কলোনীতে এক বছর বয়সী এক কন্যা সন্তানের পিতা সোহেল নামে এক যুবক গলায় দড়ি দিয়ে আত্বহত্যা করেন। খুলশী থানাধীন আমবাগান ময়দার মিল এলাকায় নাসরিন আক্তার নামে এক যুবতীকে নছিমন গাড়ি থেকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। কর্ণফূলী থানাধীন শিকলবাহা ক্রসিং এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভবনে আজগর আলী নামে এক যুবক মাদকসেবীদের হাতে খুন হয়।

এ ছাড়া পাহাড়তলী ও হালিশহরের নয়াবাজারে পৃথক ঘটনায় ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে স্বামী পালিয়ে যায়। অন্য অপরাধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে, সদরঘাটে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিগুলোতে ডাকাতির পরিকল্পনার অভিযোগে পাঁচ ডাকাত আটক, বাকলিয়া থানাধীন নতুন বীজ এলাকায় দিনেদুপুরে পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ, ভুয়া ম্যাজিষ্ট্রেট সেজে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে দেওয়ার অভিযোগ। মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারানোর অভিযোগ, প্রতারনা, স্বর্ন চোরাচালান, বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিহত হওয়ার পরও বনভোজনের নামে কৌশলে কক্সবাজার থেকে ইয়াবা চোরাচালান সহ অপরাধের ঘটনা।

২০১৮ সালে নগরীর ১৬ থানায় ৭৫টি খুনের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ৬৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা, ১০৮টি চুরি, ৬টি ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন ৪০৫টি, ১১টি অপহরন, ৪ হাজার ৭শ ৪৭টি মাদক মামলা, ৫৯টি চোরাচালান সহ বিভিন্ন অপরাধে মোট ৭ হাজার ৭৩১টি মামলা দায়ের হয়। এ ব্যাপারে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার ফারুক উল হক বলেন,’ নগরীতে যেসব খুনের ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর ৯৫ শতাংশ হচ্ছে পরিবারকেন্দ্রীক। এগুলো সামাজিক বিষয়। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কারনে কিছু হত্যাকান্ড হয়ে থাকে বলে তিনি জানান’। সর্বশেষ পুলিশ পরিচয়ে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে জোরপুর্বক টাকা আদায়ের অভিযোগ দুই নারী সহ পাঁচজনকে আটক গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

সংঘবদ্ধ এই চক্রের সদস্যরা গত পাঁচ বছর ধরে নগরীতে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে এ ধরনের অপরাধ করে আসছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার মেহেদী হাসান বলেন, গত ৮ মার্চ শুক্রবার বিকেলে নগরীর চশমা হিলের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, নোয়াখালী হাতিয়ার উত্তর রেহানিয়া গ্রামের মো: রফিকুল মাওলার ছেলে দিদারুল ইসলাম ওরফে দিদার (৩৫), ফেনীর সোনাগাজির মৃত জহিরুল ইসলামের মেয়ে ফাতেমা ইয়াছমিন নিশি (২৮) ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার লেমশীখালী গ্রামের মৃত আলী হোসেনের মেয়ে বিথিত মাহমুদ মোস্তফা সিফা (২৩)। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে বায়েজিদ বোস্তামীর শান্তিনগর এলাকার মৃত ফটিক মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন আনু (৪৪) ও ফেনী পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মো: জসিম উদ্দিনের ছেলে রাকিব আল ইমরান (২৬) ।

নগর পুলিশের দক্ষিন জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ মো: আব্দুর রউফ জানান,’ নগরীর স্টেশন রোড়ের নুপুর মার্কেটের দোকানদার মো: ইমরান (৩২) গত ২ মার্চ রাত পৌনে ১০ টার দিকে দোকান বন্ধ করে সিএনজি টেক্সিতে করে চমেক হাসপাতাল যাচ্ছিলেন। ট্যাক্সি কাজীর দেউডির মোড়ে যাবার পর রাস্তায় দাঁড়ানো তিন ব্যক্তি সেটিকে থামার সংকেত দেন। আর থামার পর তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে ইমরানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনে। এরপর কোতোয়ালী থানায় নেওয়ার কথা বলে আরেকটি সিএনজি ট্যাক্সিতে তুলে চোখ বেঁধে নগরীর চশমাহিল এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে নারীর সঙ্গে ইয়াবা দিয়ে আপত্তিকরভাবে তার ছবি তোলে সাংবাদিক নামধারী একজন। সেই ছবি ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোডের ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপন দাবী করে।

পরে বিকাশের মাধ্যমে তিন দফায় ৫৫ হাজার টাকা আদায় করে ৩ মার্চ বিকেলে ছেড়ে দেয়। কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ’ঘটনার ৬দিন পর ইমরান থানায় এসে মামলা দায়ের করেন। এরপর আমরা আসামীদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামি। পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও কামরুল হাসান নামে একজন এখনও পলাতক আছে’। ওসি বলেন,’ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি, ইমরানকে রাস্তা থেকে থেকে তুলে নিয়েছির দিদার, কামরুল ও রাকিব।

চশমা হিলের বাসায় আগে থেকে অবস্থান করছিল নিশি ও সিফা। এক পর্যায়ে আসে আনোয়ারও। সিফাকে ইমরানের পাশে বাসিয়ে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়। এ সময় ইমরান ছবি তুলতে না চাইলে আনোয়ার তাকে মারধর করে। পরে ইয়াবা দিয়েও ছবি তোলা হয়। কামরুল সাংবাদিক সেজে ছবি তোলে। সেই ছবি ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড়ের ভয় দেখায়’। পুলিশ সুত্র বলছে,’এরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। গত পাঁচ বছর ধরে এই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। এর আগে একবার পাহাড়তলী থানায় গ্রেপ্তার হয়েছিল এ চক্রের কয়েকজন। কমপক্ষে ৫০টি অপহরনের ঘটিয়েছে তারা। প্রতিমাসে অন্তত একটি অপরাধ তারা করে। চক্রের মুল হোতা হচ্ছে দিদার ও নিশি। তারা স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নেয় এবং ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে। বাস্তবে তারা স্বামী স্ত্রী নয়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.