কলকাতার রোজনামচা ও বিহারী বিড়ম্বনা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটি নিউজ : আকাশ খানিকটা মেঘলা। মনটা ছিল ভারী। এর মধ্যে যেতে হল ভারতের কলকাতা। গত ৯ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছালাম স্বস্ত্রীক। সাথে আমার ছোটছেলে শাহরিয়ার সিদ্দিকী গেল বিদায় জানাতে। রোডিং পাস ও ইমিগ্রেশন শেষ করে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের ফ্ল্যাইটে চড়ে বসলাম। দুপুর দেড়টায় কলকতায় নেতাজী সুভাষ বসু বিমানবন্দরে অবতরন করল। যথারিতি ইমিগ্রেশন ও বেল্ট থেকে মালামাল নিয়ে ট্যাক্সী ষ্ট্যান্ডে গেলাম। চালক সমিতির সিরিয়াল ট্যাক্সী হলুদ রঙের এমবেসডর গাড়ি।

কাউন্টারে মারকুইজ ষ্টেট যাব বলতেই বললো, সাড়ে ৫শত রুপি লাগবে দাদা। কিছু কম হবেনা, বলতেই চটে গেল ব্যাটা। ৩টা ফি শপিং মল পেয়েছেন। দরদাম এখানে চলে না। যা বলেছি তাই। অথচ প্রকৃত ভাড়া হল সাড়ে ৩শত রুপি। আমার প্রথম কলকাতা সফর। পথঘাট চেনা নেই। সেই ভাড়াতেই রাজী হলাম।

নির্ধারিত ট্যাক্সী ক্যাবে উঠার পর ড্রাইভার বলল, দাদা আপনার ঠিকানার পাশেই ভাল হোটেল আছে, দেব? বললাম ঠিক আছে। প্রায় এক ঘন্টা পর মারকুইজ ষ্টেটের পাশে পার্ক ষ্ট্রীটে একটি অত্যাধুনিক হোটেলে নিয়ে গেল ড্রাইভার। দরদাম করে তেরশত রুপিকে একটি কক্ষে গিয়ে উঠলাম। কক্ষে উঠার পর দেখলাম রুমটা জরাজীর্ণ ও গন্ধময়। কিন্তু উপায় নেই স্থানান্তরে। সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে পৌঁছাতে হবে ১৭ কিলোমিটার দুরে গডিয়াতে ডাক্তারের চেম্বারে। সিরিয়াল ছিল দুই নম্বরে। কোনমতে হোটেলে স্বস্ত্রীক গিয়ে ভাত খেয়ে ছয়টার আগেই ট্যাক্সীক্যাব নিয়ে ছুটলাম গড়িয়ার উদ্দেশ্যে।

ডা: সুধীর সাহা (অর্থপেডিক) একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক জেনে চট্টগ্রামে বন্ধুবর জহির ভাইয়ের পরামর্শে ও ঠিকানায় ডাক্তারের এই চেম্বার ’অর্থকেয়ারে’ যাওয়া। ট্যাক্সীক্যাব ছাড়লামনা রেখে দিলাম। রাত সাড়ে ৯ টায় ডাক্তার দেখিয়ে হোটেলে ফিরলাম। দুজনেই হোটেলের পাশে আরাফাত হোটেলে খাওয়া দাওয়া সারলাম। তখন রাত ১১ টা। পরেরদিন সকালে সকালে এই হোটেল ছেড়ে মারকুইজ ষ্টেটে সম্রাট হোটেলের পাশে আফরিন ইন্টারন্যাশনালে উঠলাম। বেশ পরিস্কার হোটেলটি। প্রায় সব হোটেলের মালিক অবাঙ্গালী। এদের বাড়ি বিহার ও পাটনায়। এরা বাঙালী বিদ্বেষী ও মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরন করে থাকে।

১০ মার্চ সকালে মির্জা গালিব ষ্টেটের পাশে ইষ্টার্ন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ডাক্তারের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা করতে গেলে রিসেপশনের কর্তব্যরত ভদ্রমহিলা জানালেন,’ আপনাদের টেস্টগুলো আজ হবে না। কাল বিকালে আসতে হবে এবং পরশু রিপোর্ট পাবেন। ইউরিক এসিড (বাত) এর টেস্টের ব্যাপারে বলল,’সকালে খালী পেটে আসতে হবে। অথচ আমাদের দেশে ভরাপেটে টেষ্ট করে রোগীর বারোটা বাজাচ্ছে। বাংলাদেশের তুলনায় টেষ্টের খরচ অনেক কম। ডাক্তারের ফিও অনেক কম। ডাক্তারী পরীক্ষার পাশাপাশি ২/১ জায়গায় গেলাম স্ত্রীর মানসিক প্রশান্তির জন্য।

ভিক্টোরিয়া পার্ক, সায়েন্স সিটি, কফি হাউজ, যাদুঘর, কলকাতা ইউনিভার্সিটি, নিউমার্কেট সহ বিভিন্ন স্থানে বেড়ানো হয়েছে ফাঁকে ফাঁকে। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে গেলে আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে বাবার সেই সার্টিফিকেট। আমার বাবা মরহুম এম.এইচ সিদ্দিকী ১৯৪৮ সালে এই ইউনিভার্সিটি হায়ার সেকেন্টারী (এইচ.এস.সি) পাস করেন। ১৯৪৭ দেশভাগের পর আমার বাবা ১৯৪৮ সালেও কলকাতায় অবস্থান করছিলেন শুধু লেখাপড়ার জন্য। পরবর্তীতে তিনি আসাম রেলওয়েতে চাকুরী নেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরম পর্যায়ে পৌছলে তিনি তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে গেল কর্তব্যরত পুলিশ বাধা গেয়। কিন্তু বাংলাদেশী পরিচয় পাওয়ার পর একজন সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে আমাদের পরিদর্শনে সহযোগিতা করেন। দুই দফা ডাক্তার ও দুই দফা পরীক্ষা-নীরিক্ষা কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। ডা: সুধীর সাহা ভাল একজন অর্থপেডিক প্রফেসর।

তৃতীয় দিন ডাক্তার দেখানোর পর ঔষধপত্র ক্রয় করলাম প্রায় দেড় মাসের। ঔষুধের দাম বেশি। তবে তাদের ঔষুধ বেশ কার্যকর। কলকাতার মারকুইজ ষ্ট্রেটে শত শত বাঙালী বাংলাদেশী বাসযোগে এখানে আসছেন এবং যাচ্ছেন। বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভাল নয়। রোগীর ভুল কিচিৎসা করে উল্টো হামকো ও আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। রোগীদের সাথে প্রায় ডাক্তার খারাপ আচরন করেন। আমার সহযোদ্ধা সাংবাদিক রুবেল খানের শিশুকন্যা রাইফার মৃত্যু তার জলন্ত প্রমান। কফি হাউজে গিয়ে দেখলাম চিমচাম ভাল পরিবেশ। জমজমাট আড্ডা। আমার স্ত্রী বললেন, এটা ইতিহাসের অংশ।

কপি হাউজে যেতে ট্যাক্সিক্যাবে চড়েছিলাম সকালে। সিগন্যাল পড়াতে গাড়ি থামল এক জায়গায়। গাড়ির সামনে দেখা গেল হেলমেট ছাড়া মোটরবাইকে তিনজন। আমার স্ত্রী ড্রাইভারকে বললেন,’ দাদা এরা হেলমেট ছাড়া কেন? তখন ড্রাইভার বললেন,’ আরে কি বলেন,’ এরা দিদির ভাই। ওদের হেলমেট লাগে না। ঘটনা হল এরা অবাঙালী ছোকরা। কলকাতার রাস্তাঘাট কোন কোন জায়গায় পরিস্কার পরি”ছন্ন। কোথাও আবার নোংরা আবর্জনায় পরিপুর্ন। বড় বাজার ও জাকারিয়া ষ্ট্রিট মনে হল, আমাদের খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মত। মারকুইজ ষ্টেটে বাংলাদেশীদের পদচারনা বেশি। তবে হোটেল রেস্তোরার মালিক ও ম্যানেজারদের ব্যবহার ভাল নয়। এরা বাংলাদেশীদের সাথে সবসময় খারাপ আচরন করে থাকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বিহারীরা আমাদের দেশে হত্যা ধর্ষন ও নির্যাতন চালিয়েছে। ফেরার দিন ১৫ মার্চ খুব ভোরে উঠে প্রস্ততি নিলাম। ট্যাক্সিক্যাব ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে এসে থামলে মালামাল নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে ইমিগ্রেশন ও বোড়িং পাস নিয়ে ডিউটি ফ্রি শপে এলাম। চড়াদামে এখানে জিনিসপত্র বিক্রি হয়। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসুর নামে এই বিমানবন্দরটি অনেক বড় একটি বিমানবন্দর। সুন্দর ও পরি”ছন্ন। এখানে প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বিমান উঠানামা করে।

দুপুরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছালাম। যথারিতি আনুষ্টানিকতা শেষে নিরাপদে বাসায় ফিরলাম। আমাদের দেশে ও কলকাতায় বিমানবন্দরে কোন ভোগান্তী চোখে পড়েনি।

ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম খুব বেশী। আইনও তারা মেনে চলেন। কলকাতায় চিকিৎসা নেওয়া বাংলাদেশীদের দেখে মনে হল দেশের চিকিৎসার উপর তাদের কোন আস্থা বা ভরসা নেই। কলকাতা বিমান বন্দর ও মারকুইজ ষ্টেটে অনেক পঙ্গু বাংলাদেশীকে দেখা যায়। যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছে। স্থানীয় কলকাতার বাসিন্দাদের ব্যবহার ও আচার আচরন অত্যন্ত ভাল। তার প্রমান ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখানোর পরে রাত বেশী হয়ে দাওয়ায় আমি অসহায় বোধ করি। কারন আমার হোটেল থেকে ডাক্তার চেম্বারের দুরত্ব ১৭ কিলোমিটার। তখন ডাক্তারের এটেনডেন্ট টেক্সিক্যাব উভার কল করে আনেন এবং আমাদের হোটেলে ফিরতে তিনি সহযোগিতা করেন।

টেক্সিতে উঠার পর এটেনডেন্ট বলেন,’ হোটেলে পৌঁছে ফোন করতে বললেন। এক ঘন্টা পর আমি হোটেলে পৌছে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। ডাক্তার এবং এটেনডেন্ট এর ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার স্ত্রীর ডানহাতে কব্জিতে একটি ছোট অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে বলেছিলেন ডাক্তার। আমি রমজানের পর এসে করব, বললে তিনি বলেন, অতদুর চিন্তা এখন করবেন না। ঔষুধের উপর আস্থা রাখুন। আপনি দুমাস পরে আসুন তার পরে দেখা যাবে। অপারেশনের ফি ডাক্তার বললেন না। অর্থের প্রতি যে তাদের লোভ নেই এটা দেখে আমি অভিভুত হলাম। অথচ আমাদের দেশের ভীন্নচিত্র। অপারেশন করার প্রয়োজন না হলেও অপারেশন করা হয়। আমার স্ত্রী ডাক্তারকে বললেন,’আপনার একটি ছবি নেব। ডাক্তার বলেন, নিন।

আমাদের দেশে কোন ডাক্তারকে ছবি তোলার কথা বলা হলে,’ তিনি বলবেন, আমার সিরিয়াল চলছে! সময় নেই। তবে কলকাতার ডাক্তারদের ব্যবহার ও রোগীর সমস্যার কথা শুনতে যে মনোযোগ তাতেই রুগী অর্থেক ভাল হয়ে যায়। ডাক্তাররা রোগীর রোগ নিরাময়ে আন্তরিক ভাবে কাজ করেন আর প্রয়োজনের বেশি ঔষুধ লিখেন না। বাঙ্গালী অধ্যুষিত মারকুইজ ষ্ট্রেটে অবাঙালী দ্বারা পরিচালিত হোটেলগুলোতে মালিকদের হাঁটডাক শোনা যায়,’দুই চাউল এক কিমা লেই ল’।লেখক- সহকারী সম্পাদক,আজকের সূর্যোদয়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.