চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই
জুবায়রে সদ্দিকিীঃ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর কতিপয় নেতাদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু হয়েছে। ক্ষমতার হালুয়ারুটির ভাগ ভাটোয়ারা, নেতাদের আনুকুল্য লাভের প্রতিযোগিতা, ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদাবাজি, ঠিকদারী , মাদক ব্যবসা ও এলাকার নিয়ন্ত্রন নিতে মরিয়া এসব নেতারা। রাস্তায় নামানো হয়েছে কিছু উশৃঙ্খল কিশোর যুবকদের। যাদের অধিকাংশ মাদকাসক্ত। হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। মাদকের নেশা ও যৌবনের রক্তের গরমে নেতার নির্দেশে তারা হামলা, সংঘর্ষ এমনকি খুনের মত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা নিজেদেন নামে বাহিনী তৈরী করেছেন।
যার বদৌলতে নগরী ও জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই ঘটছে সংঘাত, সহিংসতা ও গোলাগুলির ঘটনা। যুবলীগ বা ছাত্রলীগ নেতার পরিচয়ে ফুটপাতের চাঁদবাজি, থানার দালালী, দখল-বেদখল, মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রন সহ সব অপকর্ম চলছে। ভিন্ন মতাদর্শ রাজনৈতিক দলের কেউ মাঠে নেই। লীগই লীগের প্রতিপক্ষ। ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশ থাকছে নিরব অথবা দায়সারা অভিযান চালিয়ে নিরিহ লোকজনকে ধরে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নগরীর ২নম্বর গেট কাঁচা বাজার এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তৈয়ব হোসেন রুবেল (৩০) নামে একজন পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি একটি ইস্পাত ফ্যাক্টরীতে কর্মরত । গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তৈয়বের শরীরে তিনটি গুলি লেগেছে বলে জানা যায়। একজন গুলিবিদ্ধ ছাড়াও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে এ ঘটনায়। আহতদের বেসরকারী ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ ঘটনায় ধামা-কিরিচসহ ৫ জনকে আটক করার কথা নিশ্চিত করেছেন খুলশী থানার ওসি প্রনব চৌধুরী। সুত্র মতে, রেল লাইন সংলগ্ন ফুটপাতে বসা মাছ ও কাঁচা তরকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে যুবলীগের একটি গ্রুপ নিয়মিত চাঁদা আদায় করে থাকে।
আরেকটি গ্রুপও সেখান নতুন করে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা আদায়ের চেষ্টা চালায়। এই চাঁদা আদায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দুই গ্রুপই যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। একটি যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চু ও আরেকটি মেয়র আ.জ.ম নাছি উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গুলিবিদ্ধ তৈয়বের দাবী, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত পারভেজ এবং স্থানীয় বাপ্পী, শাহীন, লিটন, আরাফাত সহ বেশ কয়েকজন আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। তারা বর্তমান মেয়রের অনুসারী। একদিন আগেও শুক্রবার ২নং গেইটের নবান্ন রেষ্টুরেন্টের সামনে তারা মিছিল স্লোগান দেয়। তাদের গ্রুপ ছাড়া আর কোন গ্রুপ নাকি এলাকায় রাখবে না।
এর জের ধরেই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়েছে বলে দাবী তৈয়বের। এ ঘটনায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে খুলশী থানায় মামলা হয়েছে। এর তিনদিন আগে টেন্ডারবাজির ঘটনায় নগরীর আগ্রাবাদ সিজিএ বিল্ডিং এলাকায় দুই গ্রুপের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়েছে। ঘটনাস্থাল থেকে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। গত ২৪ এপ্রিল দুপুরের পর এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়,’আগ্রাবাদ সিজিএ বিল্ডিংয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে টেন্ডারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রথমে হাতাহাতি হয়, পরে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। পরে ডবলমুরিং থানা পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
নগর পুলিমের ডবলমুরিং জোনের সহকারী কমিশনার আশিকুর রহমান বলেন,’টেন্ডার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সংঘর্ষ ঝামেলা হয়েছে। স্থানীয়দের মতে যুবলীগের দুইটি গ্রুপ এই সংঘর্ষে জড়ায়। এর আগে গত ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি’র) ভবন নির্মানকাজে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে গণপুর্ত কার্যালয়ে যুবলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১৫জনকে গ্রেপ্তার করে। সিএমপির ডবলমুরিং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুদীপ কুমার দাশ বলেন, সিএমপির ডবন তৈরীর ঠিকাদারী কাজ নিয়ে গনপুর্ত বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ঠিকাদারদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। সেখান থেকে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫১ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সুত্র মতে, সিএমপির ভবন নির্মানকাজের ঠিকাদারী পেয়েছেন মোস্তফা কামাল টিপু নামে পাঠানটুলী এলাকার যুবলীগের নেতা। তিনি সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দুপুর বারটার দিকে আরেক গ্রুপ স্লোগান দিতে দিতে সিজিএ বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠে যায়। সেখানে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে সন্দ্বীপ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুইজন গুলিবিদ্ধ হন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারী রাতে এ ঘটনা ঘটে। এক মাস আগে জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে নগরীর ইপিজেড থানার নারিকেল তলা এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চারজন আহত হয়। এ ঘটনায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দেবাশীষ পাল দেবুর অনুসারী যুবলীগ কর্মী লোকমানের বামহাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল কেটে নিয়েছে প্রতিপক্ষ। মহাজনঘাটা এলাকার রাস্তার উপর দোকান বসানো ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ হয় বলে জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের কতিপয় নেতা একেক এলাকার ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছে। সমাজের সব অপরাধ ও অপকর্মে থাকছে তারা। তাদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। জায়গা জমির ব্রোকারী, থানার দালালী, গার্মেন্টস এর জুট ব্যবসা, শহরের ডিস সংযোগ, সিটি কর্পোরেশনের সাইনবোর্ড ব্যবসা, বিজ্ঞাপনি প্রতিষ্টান, রাস্তার কাজের ঠিকাদারী, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপের মত গর্হিত কাজে আছে তারা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন যুবলীগ এখন পরিনত হয়েছে কতিপয় অপরাধীদের নিরাপদ ঠিকানা। সচেতন মহল মনে করেন,’ অবিলম্বে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করে মেধাবী ও শিক্ষিত নেতাদের সমন্বয়ে নগর ও জেলায় যুবলীগকে ঠেলে সাজানো প্রয়োজন। না হয় সরকারের হাজারও উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাফল্য, সারাবিশ্বে অর্জিত সম্মান, জনগনের শতস্ফুর্ত আস্থা বিনষ্টের জন্য যুবলীগের অপকর্মই যথেষ্ট।