চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্প বাদ দিয়ে পরিচালকের রাজকীয় ভ্রমন বিলাস

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ সিডিএ’র জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাঈনুদ্দিন ৫৮ লাখ টাকা দামের টয়োট হেরিয়ার জিপ গাড়িতে চড়েন। গাড়িটি বেশিরভাগ সময় নগরীর মেহেদিবাগ সিডিএ আবাসিক এলাকায় পার্কিং স্পেসে থাকে। এই গাড়িটি ছাড়াও তিনি সিডিএ’র একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় ৬০ লাখ টাকা দামের আরও একটি গাড়ি পরিচালকের জন্য অপেক্ষা করছে। সিডিএর দায়িত্বশীল সুত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

মেহেদিবাগ সিডিএ আবাসিকে থাকা টয়োটা হেরিয়ার জিপটির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর চট্টমেট্রো ঘ-১১-৩৫৭৬। গাড়িটির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৪৯৩ সিসির এই গাড়িটি নগরীর ও আর নিজাম রোড় আবাসিক এলাকার রোড় নম্বর ৯, বাড়ি নম্বর-১০৩ এর ডেথিস নামের একটি কোম্পানীর নামে রেজিষ্ট্রেশন করা।

গত বছরের ডিসেম্বরে গাড়িটি রেজিষ্ট্রেশন নেওয়া হয়। এ বিষয়ে কথা হয় এই বাড়ির মালিক মোহাম্মদ নাসিমের সাথে। তিনি বলেন, আমার নামে কোন গাড়ি নেই। আর আমার এখানে যে দুটি অফিস ভাড়া হিসেবে রয়েছে সেখানে ডেথিস নামে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাই গাড়ির বিষয়ে কিছু জানি না’। এদিকে গাড়ির পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমনেও রয়েছে তথ্য গোপনের প্রভাব। তিনি তথ্য গোপন করে ব্যক্তিগত পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমন করেছেন। সরকারের জলাবদ্ধতা নিরসন মেগাপ্রকল্পের এই পরিচালক গত এক বছরে সাতটি দেশ ভ্রমন করলেও এতে সরকারের অনুমোদন ছিল না। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন এই কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, সরকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বহি: বাংলাদেশ ভ্রমনের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন পত্র (জিও) প্রয়োজন হয়। আমরা সেই অনুমোদনপত্র দেখে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দিয়ে থাকি। যদি কারো পাসপোর্টে সরকারী চাকরীর কথা উল্লেখ না থাকে তখন কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে সাধারন মানুষের মতো তার দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাধারণ পাসপোর্টে দেশের বাইরে যেতে পারে কি-না জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপুর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিক (প্রশাসন অনুবিভাগ) ড. মোহাম্মদ আফজাল হোসেন বলেন, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা সরকারি পাসপোর্টে সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশের বাইরে যাবেন। এর আওতায় সকল মন্ত্রনালয়ের অধীন সকল স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে। যদি কেউ ব্যক্তিগত পাসপোর্টে দেশের বাইরে যান সেক্ষেত্রে কী হবে জানতে চাইলে বলেন, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি অবশ্যই তথ্য গোপন করে দেশের বাইরে গিয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তা চাকরি নিয়ে সমস্যা হতে পারে।

প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন সিডিএ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে গিয়েছেন, এমন কথা জানালে তিনি বলেন, সিডিএ চেয়ারম্যান ওই প্রকৌশলীকে সংস্থা প্রধান হিসেবে ছুটি দিতে পারেন। কিন্তু সেই ছুটি নিয়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেন না। দেশের বাইরে যেতে হলে তাকে অবশ্যই সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। চাকরির সমস্যার কথা স্বীকার করে চট্টগ্রামের অপর একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফয়জুল্লাহ বলেন, সরকারি আইনে সংস্থা প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন এবং সংস্থা প্রধানের নিচ থেকে সহকারী প্রকৌশলী পর্যন্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বিদেশ সফরে যেতে হয়। এটা ব্যক্তিগত কিংবা অফিসিয়াল যে কোন কাজে হোক না কেন। যদি কেউ এর ব্যত্যয় করে তাহলে পাসপোর্ট আইনে তার বিরুদ্ধে মামলাও হতে পারে।

সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী সরকারি অনুমোদন ছাড়া বিদেশ গমন করতে পারে না জানিয়ে সরকারের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু বলেন, যদি কেউ সরকারের অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে গিয়ে থাকে তাহলে তিনি তথ্য গোপন করে গেছেন যা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। পাসপোর্টে সিডিএ চাকরির কথা উল্লেখ না থাকায় হয়তো সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেছেন। পাসপোর্ট দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সাথে একমত পোষন করে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন,’ পাসপোর্ট শুধ প্রকৌশলী লেখা থাকলে সহজেই তিনি পার পেয়ে যেতে পারেন। সরকারী প্রতিষ্ঠান উল্লেখ থাকলে আমরা জিও চাই’।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন । তিনি গত বছরে আমেরিকা, চীন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল ও পানামা ভ্রমন করেছেন। এর মধ্যে আমেরিকা গিয়েছেন দুই দফায়। এক বছরে একজন সরকারী কর্মকর্তা এতবার বিদেশ যেতে পারে কি না তা নিয়ে খোদ সিডিএ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

চলতি বর্ষায় জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কায় চট্টগ্রাম নগরবাসী। এ নিয়ে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পরিচালকের কোন চিন্তা ভাবনা আছে মনে হয় না। তিনি ব্যস্ত আছেন বিদেশ ভ্রমনে। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এর প্রকৌশলী গত এক বছরে সাত দেশে ঘুরেছেন। এর মধ্যে দুই দফায় গেছেন আমেরিকা। তার সর্বশেষ ভ্রমনের সুচি ছিল গত ২৯ এপ্রিল থেকে ১১ মে পর্যন্ত পানামা ও আমেরিকা। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালের আগস্টে সাড়ে পাঁচ হাজারেেকাটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। আর অনুমোদনের পর থেকে সিডিএ’র পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে আরএস
রেকর্ড অনুযায়ী খালের জায়গা ফিরিয়ে আনা হবে।

খালের উভয়পাশে ১০ ফুট চওড়ার রাস্তা নির্মিত হবে। কিন্তু প্রকল্পের প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হলেও এখনো খালের উভয় পাশের রাস্তা নির্মানের জন্য অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেনি সিডিএ। এতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনষ্ট্রাকশন ব্রিগেডের মহাপরিচালক আহমেদ তানভির মাজহার সিদ্দিকী জানিয়েছেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সিডিএ এখনো খালের উভয় পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দেয়নি, এতে রাস্তা নির্মান কাজ বিলম্ব হচ্ছে। একই সাথে জলাবদ্ধতা নিরসনের সরঞ্জাম পরিবহনেও সমস্যা হচ্ছে।

গত বছরের এপ্রিলে সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর সিডিএ যেন এই প্রকল্পের কেউ নয়, এমন ভান করছে। সম্প্রতি পরিবেশ আন্দোলনের জলাবদ্ধতা বিষয়ক এক সেমিনারে সংগঠনটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি সিকান্দার খান বলেন, সরকার থেকে প্রকল্প পাশ করে এনেছে সিডিএ। যদিও সিডিএ ও সেনাবাহিনীর সমঝোতা স্মারকের প্রেক্ষিতে মাঠ পর্যায়ে সেনাবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু জনগনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে সিডিএ’কে। এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন। সিডিএ’র অধিকাংশ কর্মকর্তা কর্মচারীদের অভিযোগ, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক তো দেশেই থাকেন না। এক দেশ থেকে আসার পর আরারও তিনি আরেক দেশে ভ্রমনে চলে যান। কখনো ট্রেনিং এর নামে, কখনো ব্যক্তিগত কিংবা কখনো জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অধীনে ভ্রমন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.