আওয়ামী লীগের দশ বছরেও চট্টগ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতায় ভাসছে

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ মাত্র ২৪ ঘন্টার টানা বর্ষণে অচল হয়ে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গত ৬-৭ জুলাইয়ের বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বিস্তীর্ন এলাকা। জলাবদ্ধতার কারণে কোন কোন সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। পানিতে ডুবে গেছে নগরীর নিচু এলাকার বাসাবাড়ি। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, অভিভাবক, চাকরিজীবী ও নিন্ম আয়ের মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে বেশি।

আবহাওয়া অফিস সুত্র মতে, ১ দিনে আমবাগানে ২৫৯ দশমিক ৯ মিলিমিটার ও পতেঙ্গায় ১৮৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট এই বর্ষণে নগরীর অনেক দোকান ও বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। পানি উঠে আগ্রাবাদ বেপারী পাড়া, ছোটপুল, সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ, মুহুরীপাড়া, বিল্লাপাড়া, শান্তিবাগ, হালিশহর হাউজিং ষ্টেট, আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা, মুগলটুলী, সিডিএ এভিনিউ, ষোলশহর, ২নং গেট ও সংলগ্ন মুরাদপুর, শুলকবহর, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, কাপাসঘোলা, চকবাজার, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট মোড় থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, অক্সিজেন মোড় এলাকা। সড়কে কমে যায় গণপরিবহনও।

পানির সাথে পাল্লা দিয়ে যানজটের পাশাপাশি গাড়ি ভাড়াও বেড়ে যায় কয়েকগুন। বন্ধ হয়ে পড়ে অনেক এলাকার খাবার দোকানগুলো। এতে দুর্ভোগ ও দুর্দশায় পড়েন নগরবাসী। পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকায় চাল-ডালের আড়ত, শুটকিপট্টি, তেলের দোকান, ভুষির আড়ত, মসলার বাজারের বেশকিছু দোকানের মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। সড়কের ওয়াসার খোঁড়াখুড়ির কাজ শেষ না হওয়ায় সৃষ্ট গর্তে জমে আছে পানি। এসব গর্তে পড়ে একাধিক হতাহতের ঘনটা ও রিকশা ও যানবাহন উল্টে দুর্ঘটনা ঘটছে। ভারি বৃষ্টিতে হেমসেন লেইন এলাকায় ১ নম্বর গলির একটি নির্মানাধীন বহুতল ভবনের সীমানা প্রাচীর ধ্বসে পড়েছে। জলাবদ্ধতার কারনে বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়েঠে। ফ্লাইওভারগুলোতে দেখা দিয়েছে যানজট। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকাতেও পানি উঠে। তলিয়ে যায় আবাসিকের সব সড়ক। পানিবন্দী হয়ে পড়ে মানুষ।

অধিকাংশ ভবনের নিচতলায় পানি ডুকে পড়ে। পানি প্রবেশ করে দোকান ও শিক্ষা প্রতিষ্টানেও। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে দেখা দিয়েছিল গনপরিবহন সংকট। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়েও লোকজনকে গাড়িতে উঠতে হিমশিম খেতে হয়। নগরীর ওয়াসার মোড়, বাকলিয়া, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ, দুই বছর ধরে সংস্কার চলা আগ্রাবাদ এক্সেস রোড় ও পোর্ট কানেক্টিং রোড়ও ছিল জলাবদ্ধ। পানি ডুকে যাওয়ায় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীদের কষ্ট ছিল অবর্ননীয়। বর্ষনের সাথে জোয়ারের পানি যুক্ত হয়ে পানি বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে বিপাল করে রোগী ও স্বজনরা। নগরীর ওয়াসা ভবনের নিচ তলায়ও পানি ডুকে যায়। ভারী বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানিতে যেসব রাস্তায় যান চলাচল বিঘ্নিত সে ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।

যান চলাচল বন্ধ থাকা সড়কগুলো হচ্ছে কাপ্তাই রাস্তারমাথা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর মোড়, শুলকবহর, ষোলশহর ২নং গেট, অক্সিজেন মোড়, জিইসি মোড়, চকবাজার, বাদুরতলা, ডিসি রোড়, ওয়াসা মোড়, নিউ মার্কেট থেকে আমতলা, নিউ মাকেট থেকে বিআরটিসি, জামালখান মোড়, চৌমুহনী থেকে কদমতলী, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড় থেকে এক্সেস রোড়, সদরঘাট মোড়, সল্টগোলা ক্রসিং, ইপিজেড থেকে বন্দরটিলা, মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন এলাকা।এসব এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পানি ছিল সড়কজুড়ে। শহরের অর্থেকেরও বেশি এলাকার মানুষ কার্যত দুইদিন ছিল গৃহবন্দী।

প্রবর্তক মোড়ের অবস্থা আরও করুন। সেখানে কোমরেরও অধিক পানির স্থায়ীত্ব ছিল। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বেপারী পাড়া, চকবাজার ফালাহ গলির সামনে, গনি বেকারী এলাকার লোকজন জানিয়েছেন সড়কে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানি যোগ হওয়ায় চট্টগ্রামে সৃষ্টি হয় এক মানবিক বিপর্যয়। ভুক্তভোগী এসব এলাকার লোকজন জানায়,’ আওয়ামী লীগ সরকার তিন মেয়াদে এখন ১১ বছর ক্ষমতায় আছে, অথচ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দুর করতে সামান্যতম আন্তরিকতা দেখায়নি। সিডিএ’কে দৃশ্যমান উন্নয়নের নামে হাজার-হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ফ্লাইওভার করার জন্য। এসব ফ্লাইওভারের নিচে পানি চলাচলের নালাগুলো প্রশস্ত না করায় বর্ষায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভুগছে মানুষ।

স্থানীয়দের মতে, সিডিএ’কে ৫৬১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জলাবদ্ধতা দুর করতে। সিডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান মানুষকে আশারবানী শোনানো ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সংস্থাটি। মানুষ সন্তুষ্ট নয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উপরও। ২০১৭ সালের নভেম্বরে নগরীর এক্সেস রোড় ও পোর্ট কানেক্টিং রোড়ের উন্নয়ন কাজ শুরু করলেও দুই বছরেও শেষ করতে পারেনি চসিক। কার্যত মরন ফাঁদে পরিণত হয়েছে এ দুটি সড়ক। উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে সড়ক দুটির আশপাশের এলাকার লোকজন। এসব এলাকা বাড়িওয়ালাদের ভাড়াঘর বছরের পর বছর খালী পড়ে আছে। সড়কের পাশে অধিকাংশ দোকানপাট খালী। মেহমান-অতিথি পর্যন্ত আসেন না এসব এলাকায়। বিয়ের উপযুক্ত মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছেন না অভিভাবকরা। আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’এর মত চট্টগ্রাম ওয়াসা একই সড়ক একাধিকবার খোঁড়খুড়ি মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন সরকারী সংস্থা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড় পৃথক প্রকল্প হতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এখনো প্রকল্পের কাজে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। যে কারনে নগরবাসী ভুগছেন জলাবদ্ধতায়। জলাবদ্ধতা দুর করতে সিডিএ’র ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয়ের মধ্যে ৩৬টি খালের মাটি অপসারন, ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা ভুমি অধিগ্রহন, নতুন ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মান, ১৭৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মান, ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, বন্যার পানি সংরক্ষনে ৩টি জলাধার, ৬টি আরসিসি কালভার্ট প্রতিস্থাপন, ৫টি টাইডাল রেগুলেটর, ১২টি পাম্প হাউস স্থাপন, ৪২টি সিল্টট্রেপ স্থাপন, ২০০টি ক্রস ড্রেন কালভার্ট নির্মান রয়েছে প্রকল্পে।

কিন্তু এক বছর ধরে মেগা প্রকল্প শুধু খাল পরিস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একই ভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চসিক ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্নফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। অথচ প্রকল্পের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। চট্টগ্রামের দায়িত্বশীল সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, অনভিজ্ঞ লোকজনকে দায়িত্ব প্রদান, চট্টগ্রামের উন্নয়নে মন্ত্রনালয়ের আন্তরিকতার অভাব ও শাসকদলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিরোধের কারনে সরকারের ১০ বছরেও চট্টগ্রামের মানুষ পানিতে ভাসছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.