সারাদেশে জোট-মহাজোটসহ বিরোধীদল স্থবির

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কার্যত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নেই। দুই জোটের সঙ্গে শরিকদলের দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। জোটগত কোন কর্মসুচীও নেই।

খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীন কোন্দল, গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তৃনমুলেও। যে কারনে রাজনৈতিক কর্মসুচী পালনে কর্মীদের মধ্যে রয়েছে অনিহা। বেকায়দায় আছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এখনো অনেকের নামে রয়েছে মামলা। ভয়ে ও আতঙ্কে আছেন তৃনমুলের নেতারা। দুঃসময়ে সিনিয়র নেতাদের সহযোগিতাও পাচ্ছেন না তারা। একই অবস্থা দলের মহানগর, উত্তর ও দক্ষিন জেলার। সম্প্রতি বিভাগীয় মহাসমাবেশে বিএনপির উজ্জীবিত ভাব আসলেও পরে আবার ঝিমিয়ে পড়ে।

শাসক দল আওয়ামী লীগের নগর রাজনীতি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যরিষ্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এমপি’র নেতৃত্বে। সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরাও আলাদাভাবে কর্মসুচী পালন করেন।

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে লেজেগোবরে অবস্থা। অনেক উপজেলায় দুই তিন গ্রুপে বিভক্ত আওয়ামী লীগ। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। তবে উত্তর দক্ষিন ও নগর আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীকে রাজপথে বা দলের কর্মসুচীতে দেখা যায় না।

গত দশ বছরে মন্ত্রী-এমপি’দের কাছাকাছি এসে জায়গা দখল করেছে নব্য আওয়ামী লীগাররা। ক্ষোভ রয়েছে অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দলের নেতাদেরও দেখা যায়না কোন কর্মসুচীতে। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেননকে এই মেয়াদে মন্ত্রী পরিষদে না রাখায় ঝিমিয়ে পড়েছে বাম রাজনীতি। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের অবস্থা একই।

দেশের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নামে বা সংখ্যার বিবেচনায় রাজনৈতিক ঐক্য দৃশ্যমান থাকলেও কার্যত শরিকগুলোর সম্পর্ক নড়বড়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোটগত ঐক্য তৈরী হলেও তাদের মধ্যে এখন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কোন কোন জোটের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে অনুজোট। বন্যা ও ডেঙ্গু সমস্যা নিয়ে দলগুলোর যৌথ কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

গত ছয়মাসে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করলে এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠে। বিরোধী দলগুলোর বাইরে সরকার ঘেষা অন্তত দুটি জোট আছে, যারা এখন অকার্যকর। ঘরোয়াভাবে কর্মসুচী পালন করলেও মাঠে ঘাটে বা রাজপথে নিস্ক্রিয় রয়েয়ে বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট। কোন কার্যক্রম নেই জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। গত নির্বাচনের সময় প্রায় ১৪টি দল সক্রিয় ছিল। বিদ্যমান জোটগুলোতে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ১৫২টি। জোটগুলো হচ্ছে ১৪ দলীয় জোট, ২০ দলীয় জোট, সম্মিলিত জাতীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম জোট, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া, ইসলামীক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, জাতীয় ইসলামী মহাজোট, বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এনডিএফ, গনতান্ত্রিক জোট, প্রগতিশীল জোট, হুদা জোট ও বিজেপি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনাকাঙ্কিত ফলাফলের পর দুই জোটের অন্যতম প্রধান সরিক বিএনপি কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। ঐক্যফ্রন্টকে কেন্দ্র করে দলটির তিনটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহুর্তে দলটির প্রধান চিন্তা কারাগারে থাকা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। জোট ও ফ্রন্টের নেতারা ধারনা করছেন সরকার আইনি পথে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিরুদ্ধে। সরকারের তরফে তার প্যারোল নিয়ে নমনীয়তা রয়েছে।

এ কারণে কোন আন্দোলন না গিয়ে খালেদা জিয়াকে সমঝোতার মধ্য দিয়ে মুক্ত করতে চাইছে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফন্টের অন্যতম প্রভাবশালী এক নেতার মতে, জাতীয় ঐক্যফন্ট সাত দফা দাবী ও ১১ দফা লক্ষ্য ঘোষনা করে আন্দোলনের সুচনা করে। কথা ছিল নির্বাচনের পরও আন্দোলনের প্রসঙ্গ থাকবে। কিন্তু ফ্রন্টের আহবায়ক ড. কামাল হোসেন এ বিষয়ে নিরবতা পালন করেন। বিএনপিও আগ্রহ দেখায়নি। বরং বারবার নুন্যতম কর্মসুচীর কথা বলা হলেও অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রসঙ্গত ফ্রন্টের আত্বপ্রকাশের দিন মির্জা ফকরুল বলেছিলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডির সাধারন সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেছেন, ১০ জুন ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত ছিল পরে বৈঠক হবে, কামাল হোসেন আসার পর। কিন্তু এরপর বিএনপি আর মিটিং ডাকেনি। আর দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বিএনপি ফ্রন্টকে সক্রিয় রাখতে চাইছে না। ফলে শরিক দলগুলো নিজেদের উদ্যোগে যতটুকু সম্ভব কাজ করছে। এ ছাড়া, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপির মধ্যে তিনটি ধারা রয়েছে। একেকটি ধারা একেক রকম মত পোষন করে। জাতনে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার মতে, আমি আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখছি না। কারণ প্রত্যেকে আলাদা আলাদা করে চিন্তা করছে। নুন্যতম ঐক্যের জায়গা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেই। সুতরাং যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলতে থাকবে বলে মনে করি।

বিএনপির একটি দায়িত্বশীল পক্ষ জানিয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বাস্তবতা ছিল। নির্বাচনের পর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে পরিস্থিতি থেকে বেরুতে হলে ফ্রন্টকে নতুন ভাবে সাজাতে হবে। বিশেষ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আ.স.ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে একটি জায়গায় আনতে হবে। এ বিষয়ে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিএনপি তাদের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তারা বড় দল, তারা নিজেদের গুছিয়ে আনার পর ফ্রন্টকে সক্রিয় করা হবে।

২০ বছরের জোট ২০ দলীয় জোট। সময়ের পরিক্রমায় চার দলীয় জোট, ১৮ দলীয় জোট হয়ে এখন ২০ দলীয় জোট। গত ২৭ জুন নতুন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি সহ ১৮ দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ’জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে নতুন সংগঠনের ঘোষনা দেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল অব: অলি আহমদ। এই মঞ্চে কল্যান পার্টি, জাগপা, খেলাপদ মজলিসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। নতুন নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবীতে জাতীয় মুক্তি মঞ্চ অলির। অলি আহমদ ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক। এই মঞ্চে গঠনের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে দুরত্ব তৈরী হয় তার। এলডিপির নেতাদের অভিযোগ মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে যোগদানের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতারা কার্যত বিরোধী দলের মর্যাদা হারিয়েছে।

তবে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। কোন কর্মসুচী মানুষকে প্রভাবিত করতে পারছে না। রাজপথে কর্মসুচী পালনের পরিবর্তে নেতারা বিয়ে গায়ে হলুদ ও সামাজিক অনুষ্টানে ব্যস্ত থাকছেন নেতারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারনাতেই দেখা যায় নেতাদের।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.