রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা

0

সিটি নিউজ ডেস্কঃ  মানবিক কারণে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে করে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন কক্সবাজারের পরিবেশ পরিস্থিতি। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে চরমভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। বিলীন হয়ে গেছে পাহাড়ের লাখ লাখ বিঘা বন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের ফেরত দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

সরকার বিভিন্নভাবে দৌড়ঝাঁপ করে গত নভেম্বরে সবকিছু ঠিকঠাক করার পরও রোহিঙ্গারা যায়নি নিজ দেশে। তারা নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে আগ্রহী না হওয়ায় সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনা শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেল মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, যে যাই বলুক, ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সরকারের পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে মোমেনও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশ ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’। তবে কিছু রোহিঙ্গা নেতা ও এনজিও তাদের ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। কোনো রোহিঙ্গা ফেরত যাক তারা তা চান না। প্রত্যাবর্তনকারীদের থামানোর চেষ্টা করছেন। কিছু আন্তর্জাতিক এনজিও তাদের (রোহিঙ্গা) উস্কানি দিচ্ছে।

ইউএনএইচসিআর থেকে রোহিঙ্গাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেও তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চায় না। বরং কৌশলে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের সাফ কথা— আমাদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা যাবো মিয়ানমার। তা নাহলে গুলি করলেও আমরা যাবো না।

গত রবিবার পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল ইসলাম বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যেকোনো সময় শুরু হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমও সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে বলেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেজন্য নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না।

তবে রোহিঙ্গা সেলপ্রধান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ইউএনএইচসিআরকে তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার তালিকা দেয়া হয়েছে। যারা যেতে প্রস্তুত তাদেরই বৃহস্পতিবার ফেরত পাঠানো হবে। আজ হোক কাল হোক এক কথায় তাদের যেতেই হবে মিয়ারমারে। কারণ তারা এদেশের নাগরিক নয়। কাজেই এদেশে তাদের স্থায়ীভাবে থাকার প্রশ্নই আসে না।

এদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর তিন দিনের ঢাকা সফরে এসে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ভারতও চায় রোহিঙ্গারা দ্রুততম সময়ে মিয়ানমারে ফেরত যাক। তাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ, মিয়ানমান ও ভারত— এ তিন দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এটা যাতে টেকসই হয় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এর আগেও আমরা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছি বলে জানান তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, বৈঠকে আমাদের আলোচনা খুবই ফলপ্রসু হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে মাত্রায় নির্যাতন চলেছে তাতে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ স্পষ্ট।

তাইতো তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চললেও বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের কারণে তা ব্যাহত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন উদ্যোগে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এটি ২২ আগস্ট থেকে শুরু হবে। এরপরই বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরতের জন্য সব প্রস্তুতি সরকার সম্পন্ন করলেও নাগরিকত্ব ও অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফেরত যাবেন না। এ ব্যাপারে গতকাল তারা সাফ জানায়— নাগরিকত্ব ও সম-অধিকার নিশ্চিত হলে আমরা যে পথ দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছিলাম সেটি দিয়ে ফেরত যাবো। প্রয়োজনে (বাংলাদেশে) গুলি করে আমাদের হত্যা করেন, তাতে আমরা খুশি।

এতে করে আমাদের মৃতদেহ ন্যূনতম জানাজা ও কবরের একটি নির্দিষ্ট স্থান পাবে। মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সহকারীর কার্যালয়ে স্থাপিত ‘তালিকায় নাম থাকা’ রোহিঙ্গারা সাক্ষাৎকার দিতে এসে গতকাল দুপুরে রোহিঙ্গা শরণার্থী গৃহবধূ হাসিনা বেগম, জোহরা বেগম, জামিলা আক্তার, আবু ছিদ্দিক, শামসুল আলম, আবু তাহের ও মোহাম্মদ সেলিমসহ অনন্ত ১০-১৫ জন রোহিঙ্গা আমার সংবাদকে এসব কথা বললেন।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টকনাফে হ্নীলার জাদিমোরা শালবাগান শিবিরের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সহকারী মোহাম্মদ খালেদ হোসেনের কার্যালয় থেকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনারের ১০টি দল শালবাগানের বিভিন্ন ব্লকের ঘরে প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের গিয়ে বোঝানো চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে কিছু লোক একটি দলকে বাধা দিলে হইচই শুরু হয়ে যায়।

খবর ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বাধা প্রদানকারীরা পালিয়ে যান। এরপর দুপুরের পর থেকে তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য হাতে একটি ফাইল নিয়ে ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ের পাশে স্থাপিত কক্ষে ঢুকে সাক্ষাৎকার দেন। এ সময় রোহিঙ্গা নারী রশিদা বেগম ও আবু তাহেরকে প্রশ্ন করা হয়, মিয়ানমার ফেরত যাবে কি না। উত্তরে তারা বলেন, আমরা সরাসরি না বলেছি। কারণ, আমাদের আগে নাগরিকত্ব ও অধিকার ফিরে পেতে চাই। এর সঙ্গে ধন-সম্পদ, ভিটা-বাড়ি ফেরত ও জীবনের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এরপর স্বদেশে ফিরা।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। সেখানে এখনো তাদের ওপর নির্যাতন চলছে। এ প্রসঙ্গে শালবাগান রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সহকারী মোহাম্মদ খালেদ হোসেন বলেন, এ শিবিরে ৪২ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। প্রত্যাবাসন প্রত্যাশী তিন হাজার ৫৪০ জনের মধ্যে এ শিবির থেকে তিন হাজার ৯১ জনের নামের একটি তালিকা তার কাছে এসেছে। তালিকায় যেসব রোহিঙ্গার নাম রয়েছে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাজ চলছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় অনেক রোহিঙ্গাই ক্যাম্পে নেই।

রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী আশ্রয় দেন দেশে। শুধু তাই নয়, তিনি এতোটা মানবিক হয়েছিলেন যে, নিজে একবেলা খেতে পারলে রোহিঙ্গাদেরও খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।

তারপরও তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য সরকার তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার, সভায় দেনদরবার শুরু করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলছেন, রোহিঙ্গা নিজ দেশে দ্রুত ফিরে যাক। আমাদের সমস্যার সমাধান হোক।

তারপর শুরু হয় আন্তর্জাতিকভাবে তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া। গত জুলাই মাসে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থুর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়।

সে অনুযায়ী গত ১৫ নভেম্বর ফেরতের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সরকার। তারপরও নিরাপত্তার অজুহাতে তারা যাননি নিজ দেশে। কতিপয় দেশি-বিদেশি এনজিওর গোপন ষড়যন্ত্র, উস্কানি এবং সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাধার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ফ্লপ হয়ে যায়। ভেস্তে যায় সরকারের প্রথম উদ্যোগ। এবারও বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে অনিহা দেখাচ্ছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.