রোহিঙ্গার পদভারে উখিয়া-টেকনাফবাসীর নাভীশ্বাস

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শরনার্থী ক্যাম্পে গণহত্যা দিবস পালন করেছে। প্রশাসনিক অনুমতি না পেয়েও গত ২৫ আগষ্ট সকাল সাড়ে ৯টা থেকে কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পের এক্স: ৪ এ অনুষ্ঠিত সমাবেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। দাবী আদায়ে উত্তাল ছিলো এ সমাবেশ।

এতে উপস্থিত ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটির চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিব উল্লাহ, আব্দুর রহিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ সহ অন্য নেতারা। কিন্তু এসব নেতা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রবেশের কোন অনুমতি নেয়নি। ক্যাম্প অভ্যন্তরে পুর্ব থেকে ঘোষনা দিয়ে দাবী দাওয়া নিয়ে সমাবেশ করায় স্থানীয় জনসাধারন ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

উখিয়া ছাড়াও টেকনাফের উনচিপ্রাংয়েও র‌্যালি ও শোকসভা করে রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবসন কমিশনার মো: আবুল কালাম এনডিসি (অতিরিক্ত সচিব) সাংবাদিকদের জানান, ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য একটা কঠিন দিন। এ দিন তো একটা সমাবেশ করতেই পারে। এ প্রসঙ্গে উখিয়ার ইউএনও নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সমাবেশ করার বিষয়টি জেনেছি। তবে অনুমতির বিষয়টা অবগত নন বলে জানান তিনি।

উখিয়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, সমাবেশে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি। তবে সমাবেশের অনুমতির বিষয়টি ক্যাম্প ইনচার্জ জানবেন বলে তিনি জানান। উল্লেখ্য ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট রাত থেকে রাখাইনে ভয়াবহ সহিংস ঘটনার দ্বিতীয় বছর পুরণ উপলক্ষে রোহিঙ্গারা এ দিবসটি পালন করেছে। এতে প্রায় অর্ধলাখের বেশি রোহিঙ্গা উপস্থিত ছিলেন। এতে বক্তব্য রাখেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউমান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ, মাষ্টার আব্দুর রহিম, মৌলভী ছৈয়দ উল্লাহ ও রোহিঙ্গা নারী নেত্রী হামিদা বেগম। তারা বলেন, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং বসতভিটা ফেরতসহ রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা দাবী মেনে নিতে হবে। অন্যতায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে না।

মিয়ানমারের সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের জনসাধারনের জীবনযাত্রার উপর মারাতœক প্রভাব ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের চাপে এখন স্থানীয়রাই সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়েছে। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে নিত্যপন্যের দাম বৃদ্ধি, বেকারত্বের কারনে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। উখিয়া টেকনাফের মোট জনসংখ্যা ৫ লাখ ৯৪ হাজার। এর মধ্যে রয়েছে উখিয়ায় ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬ শ এবং টেকনাফে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪ শ। সেখানে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সহিংস ঘটনার পর পালিয়ে আসা সাড়ে ৭ লাখ সহ মোট ১১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৭ জন রোহিঙ্গা বাস করছে। এসব রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভুমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে।

রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই রয়েছে স্থানীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতি ও চাষযোগ্য জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। অনেকের ভিটেবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্টান ও চাষাবাদের জমি অঘোষিতভাবে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা। দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতির কারনে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র মানুষরা। একই ভাবে শ্রমবাজারে মারাতœক প্রভাব পড়ায় নি¤œ আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফের বাজারগুলোতে প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপন্যের দাম। রোহিঙ্গাদের কারনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে অভিযোগ স্থানীয়দের।

টেকনাফ উপরের বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল রাজ্জাক বলেন, রোহিঙ্গারা ত্রান হিসেবে চাল পাচ্ছে। এ কারনে চালের বাজার মোটামুটি রয়েছে। তবে সবজির দাম আকাশচুম্বী। মাছ তো সময়মতো পাওয়াই যাচ্ছে না। একদিকে রোহিঙ্গাদের বিচরন অন্যদিকে নিত্যপন্যের বাজার গরম হওয়ায় বিপাকে পড়েছে স্থানীয়রা। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বসতির কারনে কক্সবাজার দক্ষিন বন বিভাগ নিয়ন্ত্রনাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ৬ হাজার ১৬৩ একর বনভুমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৭ একর সৃজিত বন ও ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন রয়েছে।

এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রান সংরক্ষনের জন্য ২০ টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মান ও ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভুমি ও জীববৈচিত্র্য, বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরনক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারনে স্থানীয় কিছু শিক্ষিত যুবকের ক্যাম্পে কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে পুরো কক্সবাজার জেলায় শ্রমবাজারে দেখা দিয়েছে মন্দা। রোহিঙ্গারা দিনমজুরী সহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের কাজে যুক্ত হয়ে পড়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় শ্রমিকরা।

উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ব্যবসা জানিজ্য সহ নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মাত্র দুই বছরেই রোহিঙ্গাদের অনেকেই বনে গেছে লাখপতি। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক বর্তমানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বাহিন্য নানা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে। তবে দেশের মাটিতে গড়া ৩২টি শিবিরের রোহিঙ্গাদের দোকানগুলোতে এ দেশের কোন পন্য স্থান পায় না। তারা মিয়ানমার থেকে নিত্যব্যবহার্য পন্য এনে দোকানে রাখছে। স্থানীয় লোকজন জানান, দাপটের সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য করে টাকার পাহাড় গড়ছে রোহিঙ্গারা।

এ রকম অবস্থায় রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে চাইবে কেন? অনুসন্ধানে শুধু একটি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরেই এক ডজনেরও রেশি লাখপতি রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীর খোঁজ মিলেছে। টেকনাফের নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির কেন্দ্রীক এ ব্যবসায়ীরা মিলে রাখাইনের একটি প্রসিদ্ধ বাজারের নামে এখানেও গড়ে তুলেছে মুন্ডু বাজার ও বলি বাজার। এ বাজারের শতাধিক দোকানে কোটি কোটি টাকার পন্যসামগ্রী রয়েছে বলে জানা গেছে।

এসবের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সবাই রোহিঙ্গা। দোকানে বিক্রির জন্য রাখা বেশির ভাগ পন্যই মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডে তৈরী। এই দোকানীরা ক্যাম্পে বসেই মিয়ানমার টেকনাফ সীমান্ত বানিজ্যের নামে পন্য আমদানী করেন টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে এ দেশে পন্য আনছে তারা।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে তাকে দেশের নাগরিকত্ব, জাতীয়তা সনদ, হোল্ডিং ট্যাক্স, জমির হালনাগাদ খাজনা আদায়ের প্রমানপত্র সহ অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়, কিন্তু রোহিঙ্গাদের এগুলোর কিছুই নেই। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে এসব রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন, বিভাগীয় শহর আকিয়াব ও মহকুমা শহর মন্ডু থেকে পন্যসামগ্রী সীমান্ত বানিজ্যের আওতায় নিয়ে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা টেকনাফের স্থানীয় সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসায়ীদের নামে ও সিএন্ডএফ এজেন্সির মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে পন্য আমদানী করছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা হওয়ায় তারা সে দেশের ব্যবসা বানিজ্য সহ লাভ লোকসানের হেরফের এখানকার ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি জানে। এ কারনে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে আমদানী করা পন্যসামগ্রী বিক্রি করতে আগ্রহী বেশি।

টেকনাফ ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দোকানগুলাতে চায়নিজ ও মিয়ানমারের শার্ট, লুঙ্গি, প্যান্ট ছাড়াও, ছাতা থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনসহ ইলেক্ট্রনিক্স নানা পন্যে সাজানো। এ ছাড়া আছে মিয়ানমারের আচার, জুতা-স্যান্ডেল, সুপারী ও ছাতা। এসব দোকানে বাংলাদেশী থান কাপড় ও বোরকা ছাড়া তেমন কিছু নেই।

রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফ তথা কক্সবাজার জেলা ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের জন্য বড় হুমকি। জড়িয়ে পড়ছে মাদক চোরাচালান ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়। লিপ্ত হচ্ছে খুন-খারাবি ও ধর্ষনের ঘটনায়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রোহিঙ্গা জনযোষ্ঠিকে তাদের স্বভুমে ফেরত পাঠানো প্রয়োজন। সে জন্য প্রয়োজন ধর্ম-বর্ন ও মতাদর্শ ব্যতিরেখে সকল মহলের সম্মিলিত জাতীয় ঐক্য। যত দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সম্ভব তত মঙ্গল।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.