ক্যাসিনো কালচার ও নষ্ট রাজনীতির হালচাল

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও প্রভাশালীদের বলয় ভাঙ্গতে কঠোর এ্যাকশনে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব অবস্থানকে দুর্বল করা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে চলমান অভিযান। দলীয় পরিচয়ে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করা, টাকার কুমির হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো, বলয় তৈরী করে রাজনীতি করা নেতাদের নির্মূল করতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বলছে, এর মধ্যে দিয়ে দলকে পরিশুদ্ধ করে তোলা ও জনগনের কাছে জনপ্রিয় সংগঠন করে তোলা ছিলো শেখ হাসিনার চলমান অভিযানের মূল লক্ষ্য।

কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশের উন্নয়নে যেভাবে অবদান রেখে চলেছে সেভাবে দলের ইমেজের উন্নয়ন ঘটেনি। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে দলের ইমেজও বাড়াতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এভাবেই নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড ও ঠিকাদারী ব্যবসার নিয়ন্ত্রন করে থাকেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। বলা বাহুল্য যে, কোন শাসনামলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই এই প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।

এরা এতই ক্ষমতাধর যে, সরকারী প্রশাসনেকে পাশ কাটিয়ে এসব করা সম্ভব হচ্ছে কিভাবে? অসাধু রাজনীতিক-ব্যবসায়ী এবং প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এসব দখলদারি থাকে জেলা উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত। রাজনীতির নামে এসব দখলদারির দৌরাত্ম বন্ধ করতে না পারলে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিদ্বন্ধী গ্রুপগুলোর মধ্যকার এমন সন্ত্রাস-সহিংসতা কোনভাবে কি থামানো যাবেনা? এসব বন্ধ করতে পদক্ষেপ চান স্থানীয় জনগন ও তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীগণ। খোদ রাজধানীতে আইন শৃংখলা বাহিনীর নাকের ডগায় পুলিশী প্রহরায় টাকার খনি ক্যাসিনো জুয়ার বোর্ডগুলো চালানো হতো। টাকার বস্তাগুলো স্থানীয় থানা পুলিশ প্রহরা দিতো। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষকলীগের কিছু নেতাকর্মী এসব ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। এই টাকার খনি থেকে কোটি কোটি টাকা নেতারা পকেটস্থ করতো।

সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও এসব ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বসে অভিজাত এরাকায়। নামকরা ও চিহ্নিত অনেক ক্লাবে সন্ধ্যার পর জুয়ার আসর জমে উঠে। মদ, জুয়া, নারীসহ নানা অসামাজিক কাজ চলে এসব ক্লাবে। অবাক হতে হয়, এসব ক্লাবে যারা সদস্য তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। আবার অনেকে আছেন সমাজ সেবক। দিনে লম্বা লম্বা বুলি ছাড়েন সভায় সেমিনারে। রাতে বসেন জুয়ার আসরে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই প্রতিবেদকের কাছে মন্তব্য করেছেন, কিছুদিন আমরা ছিলাম গ্যাং কালচার নিয়ে, তার আগে ছিলাম মাদক নিয়ে, এখন আবার জুয়া, ক্যাসিনো নিয়ে। আমরা এখন একটি জায়গায় আছি যেখানে আমাদের ভারসাম্যহীনতা তৈরী হচ্ছে। যেমন আগে হাউজি খেলা হতো। এখন জুয়ার প্রচলন হয়ে এসেছে ক্যাসিনো নামকরনে। আমরা অস্থিরতার মধ্যে আছি এবং আমাদের নৈতিকতার জায়গাগুলো আমরা হারিয়ে ফেলছি।

ক্ষমতাসীন দলের অসংগঠন যুবলীগের প্রথম সারির অনেকে এখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে টেন্ডারবাজী, দখলদারী, চাঁদাবজি, ইয়াবা ব্যবসা ও জুয়াড়ীতে গা ভাসিয়ে দলকে বারোটা বাজিয়ে, দেশকে রসাতলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ছে। এরা সমাজকে, রাষ্ট্রকে, দলকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করছে। রাজনীতিকে কলুষিত করে দলের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নের সম্মুখিন। কি নগর, কি গ্রাম সর্বত্র যুবলীগের তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী জড়িত। যুবলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতি এখন ক্যাসিনো রাজনীতি হয়ে নষ্ট রাজনীতির বলয়ে যেন প্রবেশ করেছে। যে কারনে নষ্ট রাজনীতি এখন দেশের মানচিত্রে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

চট্টগ্রামে আবাহনী, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে র‌্যাবের অভিযান হয়েছে। এসব ক্লাবের সাথে জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যাক্তি ও প্রভাবশালী চক্র। এই প্রভাবশালী রাজনৈতিক চক্র ফ্রি স্টাইলে অপরাধ করে বেড়ালেও আইন তাদের স্পর্শ করতে কি লজ্জাবোধ করছে আইনশৃংখলা বাহিনী। সারাদেশে এভাবে যুবলীগ নামধারীরা দেশের মধ্যে জুয়ার রাজ্যে সানাই বাজিয়ে এতদিন কিভাবে এরা কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছে এবং নাচ, গান, মদ জুয়াতে গা ভাসিয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অনেক রাঘব-বোয়াল জুয়ার সাথে ছিল সখ্যতা। এই দেশের অভ্যন্তরে যেখানে পুলিশ বেশ্যার গতর বেচার টাকায় চলে, সেখানে পুলিশ জুয়ার টাকায় ভাগ বসালে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাঘব-বোয়াল অনেকে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কেউ রাজনীতির মুখোশে ক্যাসিনোকে ব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনে।

চট্টগ্রামে তিনটি ক্লাবে অভিযানে কাউকে আটক করা সম্ভব না হলেও আলামত পেয়েছে। এভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা ছাড়াও নানা অপকর্মে জড়িত অর্ধশতাধিক অবৈধ অস্ত্রবাজ। এরা যুবলীগের প্রভাবশালী নেতাদের প্রশ্রয়ে রয়েছে। দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় পরিনত হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। রাজধানীসহ চট্টগ্রােেম অবৈধ জুয়ার আস্তানায় অভিযান নাগরিকদের মধ্যে যেমন তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে তেমনি তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এসব কি ক্ষমতাসীন দলেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনীতি ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কারোরই এসব অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতার রাজনীতির এই ওপেন সিক্রেট সবাই জানতেন। জুয়া, মদ, অস্ত্র ও মাদকসহ প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার এই রমরমা ব্যবসার ভাগীদার অনেকেই। কথিত আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রন থেকে শুরু করে ঠিকাদারী ব্যবসার টেন্ডারবাজীর সিন্ডিকেট কিংবা প্রশাসনিক তদবির রাজনৈতিক দলের গ্রুপিং-লবিং সবই জড়িয়ে যান এমন মাফিয়া চক্রে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে প্রশাসন থেকে শুরু করে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে রেখে, কী করে কত দ্রুত বিপুল পরিমান টাকা কামিয়ে নেওয়া যায়। কত দ্রুত ক্ষমতা চক্রের শীর্ষে উঠে যাওয়া যায়। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম সম্ভবত তেমনই একটি দৃষ্টান্ত।

রাজনীতিতে নীতি আর আদর্শের জায়গায় যখন অর্থ ক্ষমতাই প্রধান হয়ে উঠে তখনই কেবল এ ধরনের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরী হয়ে থাকে সমাজে। দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজধানী কিংবা সারা দেশে এমন খালেদ একজন নয়। এখন প্রশ্ন হল, এই শুদ্ধি অভিযান কি কেবল রাজনীতিতে অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধ করা কিংবা মাদক অস্ত্র সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট দমনের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়বে? নাকি তা সমাজকে জিম্মি করে রাখা ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার উৎসকে গুড়িয়ে দেবে? রাষ্ট্র যদি সকল প্রকার দূর্নীতির লাগাম টেনে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারে তাহলেই ক্ষমতার অপব্যাবহারের মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এমন অবৈধ ক্ষমতা চক্রের উত্থান ঘটে। রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে না পারলে , মমাজকে শুদ্ধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ এবং তারই নির্দেশে এসব শুদ্ধি অভিযান রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার আকাঙ্খা প্রতীয়মান। অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন দেশবাসী। কিন্তু খোলস না পাল্টালে, দীর্ঘদিনের কলুষে মরচে ধরা রাজনীতি কিভাবে পাল্টাবে। আতংকে গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দলের লেবাস কাজে লাগিয়ে অবৈধ অর্থের মালিক বনে যাওয়া চিহ্নিত চাঁদাবাজ হাইব্রিড খ্যাত নেতারা। প্রায় ১১ বছর ধরে রাজত্ব করা এসব নেতাদের এলাকায় উপস্থিতি নেই বললেই চলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি বলেছেন, জুয়া এই দেশে নিষিদ্ধ।

কোনভাবেই এই ব্যবসা চলবেনা। তাহলে এই দেশে ও এই সভ্যসমাজে এতদিন কিভাবে চলে আসছিল। কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তা এদের সাথে জড়িত ছিল তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতার ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগে ঢোকানো হয়েছে বিভিন্ন ঘরনার লোকজন। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন হাইব্রিড নেতাদের উর্বর ভূমি। গত দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে অন্তত অর্ধলক্ষ ভিন্নমতের মানুষ। এদের অধিকাংশ বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ছিলেন। স্থানীয় সাংসদ ও দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের হাত ধরে তাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগসহ সহযোগী সংগনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ত্যাগীর এ কারনে উপেক্ষিত। বহিরাগতরাই এখন নানা আকাম কুকাম করে দলের বারোটা বাজাচ্ছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.