চট্টগ্রামে গ্রেফতার আতঙ্কে ক্ষমতাসীন দলের অর্ধশতাধিক নেতা

0

বিশেষ প্রতিবেদক,সিটি নিউজ :  চট্টগ্রামে আত্মগোপনে ক্ষমতাসীন দলের অর্ধশতাধিক নেতা। রাজধানীতে সম্প্রতি ক্যাসিনো, মাদক ও অবৈধ সম্পদশালীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পরই এলাকায় দেখা যাচ্ছে না নেতাদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকার ভিত্তিতেই রাজধানীতে ক্যাসিনোতে অভিযান, ক্যাসিনো পরিচালনাকারী, দুর্নীতিবাজ-টেন্ডারবাজদের গ্রেফতারসহ অভিযান চালানো হচ্ছে। জানা গেছে, এলজিআরডি, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়াররাও টেন্ডার-বাণিজ্যের বড়ো অঙ্কের ভাগ পান। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে বেশিরভাগ কাজ বাস্তবায়ন করে এলজিআরডি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ মেরামত না করে বেশিরভাগ বিল উত্তোলন করা হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে। জড়িত টেন্ডারবাজ ও ইঞ্জিনিয়ারদেরও এই তালিকায় নাম রয়েছে। এছাড়া টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পান যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা এবং কিছু এমপি। এ কারণে উপজেলা পর্যায়ে ২০০-৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয় না। সবই হয় লুটপাট।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক নেতা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন । তাঁদের মধ্যে র‍্যাবের তালিকাভুক্ত ২০ থেকে ২২ জন চিহ্নিত অপরাধীও রয়েছেন। রয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর। এরই মধ্যে র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি নিহত হওয়ার পর সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামে ক্যাসিনো না থাকলেও খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য, জমি দখল ছাড়াও নানা গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িতদের একটি তালিকা করেছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২২ সেপ্টেম্বর নগরীর চকবাজারের কাপাসগোলা এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক নুরুল মোস্তফা টিনুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। টিনু চকবাজার এলাকার কয়েকটি কলেজ ও স্কুলের উঠতি সন্ত্রাসী ও কিশোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘টিনু গ্রুপ’ নামে সক্রিয় রয়েছে। নগরীর বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ ও চকবাজার এলাকায় এ গ্রুপ বেশি সক্রিয়। চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সাথে তার গ্রুপের সদস্যরা জড়িত থাকার প্রমাণও পেয়েছে র‌্যাব।

এছাড়া ১৩ অক্টোবর নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ২৮ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম। খোরশেদ আগ্রাবাদ এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা এবং জমি দখলের সাথে জড়িত ছিলেন বলে র‌্যাবের দাবি। এই দুটি ঘটনার পর চট্টগ্রামে সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মীদের মধ্যে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মহিউদ্দিনের কোনো হদিস নেই। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমন, যুব লীগের শীর্ষ এক নেতার ক্যাশিয়ার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া কেন্দ্রীয় যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মো. আবু জাফর আহমদ, সিআরবি এলাকার রিটু দাশ ওরফে বাবলু, জিইসি ভূঁইয়া গলির মশিউর রহমান ওরফে দিদার, নালাপাড়ার জহির উদ্দিন ওরফে বাবর, জামালখান এলাকার আবদুর রউফকে অভিযান শুরুর পর থেকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে অভিযান শুরুর দুই-আড়াই মাস আগেই দেশ ছাড়েন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর। নগরীর নন্দনকানন এলাকায় তাঁর বাসা। যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সবাই জানে। তাঁর বিরুদ্ধে রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে রাখার অভিযোগ রয়েছে। দরপত্র নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় যে ‘জোড়া খুন’ হয়, সেই মামলার আসামি বাবর।

গেল ২০১৩ সালে সিআরবি এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে জোড়া খুনের ঘটনায় বাবরের প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমনকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। তিনিও জোড়া খুনের মামলার আসামি।

আত্মগোপনে যাওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা শতাধিক বা আরো বেশি হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল হক।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামোর পাড়া-মহল্লায় অনেক যুবলীগ ও ছাত্রলীগ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। মানুষ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না। সরকারের সময়োপযোগী এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সংগঠনকে জঞ্জালমুক্ত করার সময় এসেছে।

যুবলীগের নাম ব্যবহার করে আর কাউকে অপরাধের সম্রাজ্য গড়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। চট্টগ্রামে ক্লিন ইমেজের ত্যাগী ও দেশ প্রেমিক নেতাদের নেতৃত্বে এই সংগঠন এগিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

চট্টগ্রামে অপরাধীর তালিকা তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করে র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম নগরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসার মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ২০ থেকে ২২ জনের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত অপরাধীরা ছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কোথায় কি করছেন, সব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। তাঁদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধ সম্রাজ্য গড়ে তুলছেন সবাইকে পর্যায়ক্রমে আমরা আইনের আওতায় আনবো। অপরাধী যেই হোক, কাউকে ছাড় নেওয়া হবে না।

এদিকে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুই জন নেতা জানান, শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও মাদকের অভিযোগ আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরোপুরি ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান রয়েছেন । আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতার নানা অপকর্মের তথ্যও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। এসব নেতা কোথায় কী করছেন, সে সম্পর্কে দলের বিভিন্ন সূত্র এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত তথ্যও পান তিনি। তাদের অনেকের আমলনামাও এক বছর ধরে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম প্রধান অঙ্গীকারই হচ্ছে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি রোধ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আগামী ২১ ও ২২ ডিসেম্বর দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগেই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন আনতে এই উদ্যোগ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.