কলকাতার রোজনামচা ও রিজেন্ট এয়ারের তামাশা

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ গত ৪ নভেম্বর। সকাল এগারটায় আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার বাসা থেকে সস্ত্রীক ও পুত্র নাদবিরকে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ৪৫ মিনিট পর বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় কারণঃ রিজেন্টের ফ্লাইটটি ছিল বিলম্বিত। প্রায় ৩০ বিলম্বে আকাশে উড়ে কলকাতার মাটিতে নেতাজী সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলাম।

খুব অল্প সময়ে আনুষ্ঠিকতা শেষ করে আবার ভারতীয় উবারের মাধ্যমে এক ঘন্টায় পৌঁছলাম মারকুইজ ষ্ট্রীটে। হোটেলে গিয়ে বাক্সপেটরা কক্ষে রেখে বের হলাম ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। মারকুইজ ষ্টেট থেকে গড়িয়া। এখানেই অর্থোকেয়ার নামে একটি চেম্বার রয়েছে। এই চেম্বারে বসেন অর্থোপেডিক প্রফেসর ডা. সুধির সাহা।

গত মার্চে আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছিলাম। ভালো ফল পাওয়ায় আবার সেই ডাক্তারের কাছে এলাম। প্রচুর রোগী। দেশ থেকে সিরিয়াল দিয়ে যেতে হয়েছে। তার সহকারী একজন দিদি এই চেম্বারে বসেন। অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার রোগীদের মন জয় করে ফেলে। দেশ থেকে সিরিয়ান দিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজেই খোঁজ নিয়েছেন আমাদের। এক ঘন্টায় পৌঁছলাম উবারের প্রাইভেট কার চেপে। স্বামী-স্ত্রী দুজন ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসাপত্র নিয়ে ফিরে এলাম। ডাক্তার দুজনকে ৩ মাসের ওষুধ দিয়েছেন। মারকুইজ ষ্ট্রীট এর ওষুদের দোকান থেকে ১০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে ওষুধ ক্রয় করলাম।

এরপর ছেলেকে নিয়ে দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেড়ালাম চারদিন। ইকো পার্ক, সায়েন্স সিটি, ভিক্টোরিয়া পার্ক, ও কফি হাউজে গেলাম। কলকাতার রাস্তাগুলো কোন কোন স্থানে ময়লা-আবর্জনা থাকলেও অধিকাংশ রাস্তা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, রাস্তাগুলোতে যানবাহন ট্রাফিক আইন মেনে চলার মনোবৃত্তি বেশী। কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সার্জেন্ট বা ট্রাফিক নেই কিন্তু সিগনাল মেনে চলছে যানবাহন। অলি-গলিতে রিক্সা-অটো চললেও বড় বড় সড়কগুলোতে ব্যাক্তিগত গাড়ী, বাস ও সরকারী গাড়ী চলাচল করে। ব্রিটিশের তৈরী হাওড়া ব্রিজ দেখে বেশ ভালো লাগলো। কোন পিলার ছাড়াই এই ব্রিজ। ব্রীজকে ধরে রেখেছে উপরে লোহার পাতাটন। গাড়ীর ড্রাইভার অনিন্দ পাল জানালেন মমতার সরকার ব্রীজের নীচে গঙ্গার তলদেশে টানেল নির্মাণ করছেন।

কলকাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ব্রিটিশের তৈরী বড় বড় দালানগুলো। মারকুইজ ষ্ট্রীট বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা। বিমানে ও বাসে বা ট্রেনে যারা আসেন তাদের মধ্যে অনেকে এখানে থাকেন। মুসলিম হোটেল ও মসজিদ রয়েছে এই এলাকায় বেশ কয়েকটি।

কলেজ ষ্ট্রীটের কলকাতা ইউনিভারসিটি দেখে আবেগ প্রবণ হতে হয়েছে। দেশ বিভাগের আগে অর্থাৎ ৪৬ ও ৪৭ সনে আমার পিতা এখানে এক মুসলিম বাড়ীতে জায়গীর (পেয়েইং গেষ্ট) থেকে কলকাতা ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। বাবা নেই পৃথিবীতে। কলকাতায় যখনই গিয়েছি বাবার কথা মনে পড়েছে বার বার।

সায়েন্স সিটি অর্থাৎ বিজ্ঞাননগরী বিশাল এলাকা জুড়ে কলকাতায়। টিকেট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম। বিজ্ঞানের অনেক চমৎকার বিষয় এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাসে চড়ে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষা সফরে আসতে দেখলাম। শিক্ষকেরা প্রত্যেকটি আইটেম ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন। দেখে ভাল লাগল। ইকো পার্ক দেখার মতো একটা চমৎকার জায়গা। এখানে টিকেট নিয়ে প্রবেশ করলাম। ট্রয় ট্রেন চেপে পুরো ইকো পার্ক ঘুরতে এক ঘন্টা সময় লাগে। জনপ্রতি দেড়শ রুপি ট্রেনের ভাড়া। ব্যাটারী চালিত এই ট্রেন রেললাইন ছাড়া রাস্তায় চলে। ইকো পার্কের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও স্থাপত্য নান্দনিক ও চমৎকার।

বিশাল লেকের চারপাশে রাস্তা দিয়ে ট্রেন চলে। পায়ে হেঁটে ইকো পার্ক দেখা সম্ভব নয়। ট্রেনে চড়েই এক ঘন্টা। মাঝে একটি ষ্টেশনে ট্রেন থামল। ষ্টেশনের নাম ঘুম। ইকো পার্কের ভেতর থাকার কটেজ ও ফাষ্টফুডের অনেক দোকান রয়েছে। ভিক্টোরিয়া পার্ক বিশাল এলাকা জুড়ে। সুন্দর ছিমছাম। এখানেও টিকেট করে প্রবেশ করলাম।

সবুজের এক বিশাল সমারোহ। বিশাল এই পার্ক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আমাদের দেশের মতো বাদাম ও চিপস এর কোন খালি প্যাকেট বা পানির বোতল পরিত্যক্ত নেই। স্থানে স্থানে ডাষ্টবিন। সেখাইে ময়লা ফেলছেন। ধুমপানও কেই করতে দেখা গেলনা। মান্না দে এর ঐতিহাসিক গান- কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। এই গানের কলি দু’পার বাংলার সব বয়সী মানুষের কাছে খুব পরিচিত।

ইতিহাসের সাক্ষী এই কফি হাউসে দ্বিতীয়বারের মতো গেলাম একদিন সন্ধ্যার পর। কোন টেবিলই খালি নেই। প্রত্যেকটি টেবিলে ভার্সিটির ছাত্র/ছাত্রী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিকসহ আড্ডাবাজ গুণিজনেরা চুটিয়ে আড্ডা দিতে দেখা গেল। ছাত্র/ছাত্রীদের অধিকাংশই সিগারেট ফুকছিলেন। সিগারেটের ধুয়া পুরো কফি হাউসের নীচ ও উপরের তলা ধোঁয়াচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

কফি হাউসের ঐতিহ্য হল তাদের আসবাবপত্র সেই বৃটিশ আমলের। এখনও সেভাবে আছে। দেওয়ালে লাগানো আছে তৈলসচিত্র। বয় বেয়ারাদের মাথায় পাগড়ি। খাওয়ার মানও অত্যন্ত ভালো। শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ এই কফি হাউস দেখতে আসেন। আমার চোখে পড়েছে কয়েকজন বৃটিশ নাগরিক। পার্ক ষ্ট্রীটের রাস্তা দিয়ে দেখা গেল ট্রাম যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চালিত এই ট্রাম দেখতে খুব সুন্দর। মানুষ স্বল্প মূল্যে যাতায়াত করতে পারে। ধীর গতির এই ট্রাম কলকতাবাসীর অনেক পছন্দের।

মারকুইজ ষ্ট্রীট এর পাশে পার্ক ষ্ট্রীট ও মীর্জা গালিব ষ্ট্রিট। এখানেও বাংলাদেশী পর্যটক ও রোগীর সংখ্যা বেশী। এসব স্থানে আবাসিক হোটেলগুলোর মালিক অবাঙ্গালী মুসলিম। হোটেলগুলোর বয় ও ষ্টাফদের ব্যবহার ভাল নয়। মাটির কাপে চা বিক্রয় করে মহরম। সেও অবাঙ্গালি। তার মূল বাড়ী পাটনায়। ছোট থেকে কলকাতায়। জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিদিন কতটাকার চা বিক্রয হয়। জানাল, প্রায় ১০ হাজার রুপি। এক বাংলাদেশী তাকে এসে বলল, মুদি এক কাপ চা লেও। মহরম বলল, ইয়ে হামারা প্রাইম মিনিস্টারকা নাম হ্যায়। বাংলাদেশী ভদ্র লোক বললেন, মোদী চাওয়ালা হ্যায়। মহরম হেসে বলল, “হ্যায় হ্যায়। সাচ বলা”।

আমার চিকিৎসার এক পর্যায়ে গেলাম কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তারের ফি ১২৫০ রুপি। আবার এন্ট্রি ফি ১৫০রুপি। অত্যন্ত ব্যায়বহুল একটা হাসপাতাল। এখানেও বাংলাদেশী রোগী দেখা পেলাম। প্রাইভেট এই ক্লিনিকটি সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে গড়া। তবে ডাক্তারী পরীক্ষাগুলো ব্যায় বহুল।

আমাদের চট্টগ্রাম ফিরে আসার তারিখ ছিল ৯ নভেম্বর। সে হিসেবে রিজেন্টের ফিরতি টিকেটও কনফার্ম ছিল। কিন্তু ভয়ে ছিলাম। কারণ দেশে ও কলকাতায় ৮ নভেম্বর থেকে ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। চট্টগ্রামে ছিল ৯ নম্বর মহা বিদপ সংকেত। বিপদ মাথায় নিয়ে সাত সকালে ৭ টা ৩০ মিনিটে বৃষ্টির মধ্যে একটি ট্যাক্সিক্যাবে করে বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। সারারাত টেনশনে ঘুম হয়নি। দেশে আমার ছোট ছেলে নাবিল ছিল টেনশনে।

আমাদের সাথে সহযাত্রী ছিলেন ব্যবসায়ী জাহিদ ভাই। তিনি আমাদের সাহস যোগালেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে জানলাম বিকেল ৪টা থেকে বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষনা করেছে। টেনশন আরো বেড়ে গেল। রিজেন্ট ফ্লাইট ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে যাত্রীদের নােিমই আমাদের উঠতে বলে ফ্লাইটে। প্রায় ২০ মিনিট বিলম্বে আকাশে যথন ফ্লাইট উঠেছে তখন কলকাতার আকাশে মৃদু বাতাস ও বৃষ্টি হচ্ছিল।

“বুলবুল” এর ঝড়ের সংকেতে দুই বাংলায় ছিল আতংক। আকাশে উঠার প্রায় ২০মিনিট পর ফ্লাইট কিছুটা রোলিং করে উঠে তখন পাইলট ক্যাপ্টেন জাহিদ ঘোষনা করছেন, আমরা এখন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। নিজ নিজ সিট বেল্ট বেঁধে ফেলুন। আমার আশপাশের সবাই তখন তসবিহ ও দোয়া পড়ছিলেন বিড় বিড় করে।

তবে পাইলট খুব দক্ষ ও নির্ভীক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সিগনাল পেয়েই আকাশে উড়েছিল ফ্লাইটটি। আমরা বিকাল ৩ ঘটিকায় বিমানবন্দরে অবতরন করলাম। টারমাকেই আমাদের নামিয়ে দেওয়া হল। বোডিং ব্রীজ না লাগানোর কারনে যাত্রীদের পায়ে হেঁটে লাউঞ্জে আসতে হয়েছে।

পঙ্গু ও রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের প্রতি রিজেন্টের এই তামাশা ছিল দুঃখজনক। যাওয়ার দিনও এভাবে রানওয়ের টারমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে ফ্লাইটে তুলেছে যাত্রীদের রিজেন্ট। রিজেন্ট এয়ার লাইন্সের যাত্রীদের প্রতি এধরনের আচরণ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নজরেও কি পড়েনা?

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.