কি কবা বাহে, গড়গড় করি গাও কাঁপে-গরম কাপড় দিবা বাহে

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ ফুটবাতবাসী কুড়িগ্রামের বাসিন্দা ফুলজান বিবি (৮০)। চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজের সামনে ফুটপাতের অস্থায়ী বাসিন্দা। সন্তান গেছে ভ্যান চালাতে। ফুলজান বিবি অপেক্ষায় কখন ছেলে খাবার নিয়ে আসবে। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রাম এসেছেন ফুলজান একমাত্র সন্তান হযরত আলীকে নিয়ে। শীতে কাঁপছেন ফুলজান ফুটপাতে। কাছে গেলেই ফুলজান বিবি বলে উঠলেন “ কি কবা বাহে গড় গড় করি গাও কাঁপে। হাত পাও অবশ হয়া যায়। মোর বুইড়া হাড্ডিতো সহ্য কইরবার পায়না। এমন ঠান্ডা হইলে কেমন করি বাইচমো আমরা। একটা গরম কাপড় দিবা বাহে- আল্লাহ্ ভাল কই’রবে তোমায়”।

গত শুক্রবার সকালে ফুটপাতে আলাপ হয় ফুলজান বিবির সাথে। শীতের প্রভাব পড়েছে শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও কর্মক্ষেত্রে। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রয়োজন দেখা দিয়েছে শীতবস্ত্রের। বেশী দূর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। ছিন্নমূল ও ফুটপাতের বাসিন্দারা রাতকাটান গুজো হয়ে বসে। ঠান্ডায় রাতে ঘুমাতে পারছেন না ছিন্নমূল মানুষ।

পৌষের শুরুতে দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্য প্রবাহের মধ্যেই এবার আপন মহিমায় ধরা দিয়েছে শীত। প্রচন্ড শীতে চট্টগ্রামের ফুটপাতবাসীগণ ঠান্ডায় যেন কাঁপছে। একটি গরম কাপড়ের আশায় অনেকে নগরীতে ফুটপাত, ষ্টেশন, ষ্টেডিয়াম পাড়া, বাণিজ্যিক এলাকায় বসে যেন প্রহন গুনছে। নগরীর ছিন্নমূল মানুষকে শীতবস্ত্র মাঝে মধ্যে বিতরণ করা হলেও এবছর বিতরণ কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়।

আগের বছরগুলোতে বেশ কিছু এনজিও ও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম চালাতো। এ বছর এই বিতরণ আশানুরূপ নয়। যার কারণে শীতের প্রচন্ড প্রকোপেও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা মানুষের সংখ্যাও যেন দিন দিন কমে আসছে। চট্টগ্রামে বুর্জোয়া, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। দুঃস্থ মানুষের কল্যাণে বিত্তবান মানুষের সহানুভুতি-আন্তরিকতাও যেন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিমন্ডলের চিত্র ভিন্ন ধরণের। নির্বাচন এলেই দান-খয়রাত, মেজবান, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়।

নির্বাচন নেই, পদপদবীর দৌড়ঝাঁপ নেই। দান-খয়রাতও নেই। মাঠ চষে বেড়ান নেতারা তখন চুপসে যান। শীতের কম্বল ফুটপাতে বিতরণ না করেই নিজেরাই কম্বল গায়ে দিয়ে নিশ্চিন্তমনে ঘুমান। দেশ যখন শীতে কাঁপছে তখন মানবদরদী ও মানবতার প্রতীক মানুষগুলোর দেখা যায় কদাচিৎ ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এদেশে ধনীরা ধনী হয়, গরীবেরা শুধু গরীব হয়। স্বার্থ ছাড়া একটি ছেঁড়া কম্বলও ফুটপাতবাসীকে দেওয়া হয়না এই সভ্য সমাজে। ফুলজান বিবিরা ফুটপাতে মশা ও শীতের সাথে যুদ্ধ করে রাত কাটায়। একমুটো অন্নের জন্য আহাজারি করে। এদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয়না।

এদেশে যাদের শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ আছে তারা কোট, জ্যাকেট চাদর দিয়ে শীত নিবারণ করছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষের কথা কেউ ভাবে না। এমনিতেই তারা রুটি রুজি জোগাড় করতে অতীষ্ট। তার উপর শীতবস্ত্র, কম্বল জোগাড়ের সামর্থ্য তাদের নেই। একটা সাধারণ কম্বল, একটা শীতবস্ত্র একজন মানুষকে তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচাতে পারে। জেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় প্রশাসনসহ দেশের বিত্তশালীরা এগিয়ে আসলে এমন তীব্র শৈত্য প্রবাহের সময়ে মানুষের কষ্টের জীবনে কিছুটা সান্তনার পরিবেশ তৈরী হতো। শীতে অনেকের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।

বিশেষ করে বৃদ্ধরা এখন তীব্র শীতে নাকাল অবস্থার সম্মুখিন হয়। সরকারের পক্ষ থেকে হতদরিদ্র মানুষের সহায়তা খুবই জরুরী। জনসেবা করার উপযুক্ত সময় এখন। শীতার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে এখনই। মানবিক কারনে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সরকারসহ আপনার আমার সকলের কর্তব্য। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সামর্থবান মানুষ এগিয়ে আসলে দেশের দরিদ্র সাধারণ মানুষের বিশেষ উপকার হবে।

ধনীদের সম্পদের উপর দরিদ্রদের অধিকার ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত। অতএব, আসলে ছিন্নমূল, দরিদ্র, অভাবগ্রস্থদের, বিশেষ উপকার হবে। আমরা চাই, দেশের সর্বস্তরের মানুষ শীতসহ সব ধরনের বিপদ-আপদে ও বিত্তশালী মানুষের সহায়তায় সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকুক। সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া যে শিশুটি বস্ত্রের অভাবে মায়ের কোলে ক্রন্দন করছে। যে শিশু-কিশোরেরা শীত বস্ত্র ছাড়াই দিনপঞ্জিতে দিনাতিপাত করছে তাদের পাশে বিত্তবান বা সরকারের কোন অংশের উপস্থিতি নেই।

মাহতাব মিয়া, নগরীর ষ্টেশন রোডে দুই সন্তানকে নিয়ে ফুটপাতে রাত্রিযাপন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগে। ৭ বছর ও ৫ বছরের দুই পুত্রকে আগলে রেখেছেন মায়ার বন্ধনে। হাতিয়ার নদীভাঙ্গা মানুষ মাহতাব মিয় ভিটে মাটি হারিয়েছেন সমুদ্রে। ভিটে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে ইট পাথরের এই শহরে ঠাঁই হয়েছে নগরীর ষ্টেশন রোডে। বাড়ীঘর নেই। কোন ঠিকানা নেই তার। পঞ্চাশ বছরের মাহতাব মিয়া ভ্যান চালান রেয়াজউদ্দিন বাজারে। দুই সন্তানও বাপের সাথে ভ্যান গাড়ীর সাথে বাজারে কাজ করে।

ফুটপাতের হোটেল থেকে দুপুরে ও রাতের খাবর ক্রয় করে ফুটপাতেই উদরপূর্তি করে ঘুমিয়ে পড়েন মাহতাব দুই সন্তানকে নিয়ে। না, ফুটপাতে কোন ড্রাইনিং টেবিল নেই। নেই কোন বেডরুম বা ড্রই রুম। গত সপ্তাহে মাহতাব মিয়া বললেন, রাতে ঘুমাতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলা হয় প্রায় রাতে। মাঝে মধ্যে পুলিশ এসে লাঠিপেটা করে। তবে অসহ্য লাগে যখন কুকুরের দল এসে আক্রমন করে। মাঝে মধ্যে মাঝরাতে মাতালের উপদ্রব বিরক্ত লাগে।

আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় কথা হয় দিনমজুর হারাধনের সাথে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোর হতেই ছুটে যাই কাজের সন্ধানে। শীত বাড়ার পর থেকে ৩ দিন ধরে হাতে কোন কাজ নেই। আয় না হওয়াতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চুলায় আগুন জ্বলছে না। সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত সরকারী-বেসরকারী ও ব্যাক্তি উদ্যোগে এসব অসহায় মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণের কোন উদ্যোগ নেই।

গত সপ্তাহে নগরীর আন্দরকিল্লাহ্, চকবাজার, বাকলিয়া, চেরাগী পাহাড়, আগ্রাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছিন্নমূল মানুষের রাস্তা থেকে কাগজ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত। বয়স্কদের দেখা গেছে, সিগারেট ফুঁকছেন। শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা কাঁথা মুড়িয়ে ফুটপাতের কোনায় পড়ে আছেন। দেওয়ান হাটের ওভারব্রীজের উপরে দিন মজুররা ভোর বেলায় জড়ো হন শ্রম কিক্রির সন্ধানে। হাশেম মিয়া জানান, ২/৩ দিন হয় কোন কাজ জুটছেনা।

অভাবের তাড়নায় এভাবে নগরীতে দিনমজুর থেকে ছিন্নমূল সকল মানুষ প্রচন্ড শীতে কাঁপছে। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী মানুষ মানবেতর জীবন কাটালেও সভ্য সমাজে যেন দেখার কেউ নেই। খোলা আকাশের নীচে জীবন চলে তাদের দুর্ভোগ ও দূর্গতিতে। কুকুরের সাথে কখনো, পাগলের সাথে কখনো, কখনো মদদীর সাথে এদের জীবন চাকা থমকে দাঁড়ায় অমানবিকভাবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.