অনলাইন ক্যারিকেচার ও সংবাদপত্রের বেহাল দশা

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। কেউ বাসা-বাড়ীতে, মেসে, বিপনী কেন্দ্রে, বাজারে, দোকানে বসে অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালাচ্ছেন।

আজকের সূর্যোদয়ের প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ফকিরাপুলের কাজের বুয়ারাও অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালায়। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই অনলাইন নিউজ পোর্টালের উপর। যার যেভাবে খুশী চালাচ্ছেন। কোন নিয়ম, বিধি নিষেধ কিছুই এরা মানেনা। হঠাৎ আজগুবি কোন কোন বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজে খারাপ প্রভাব ফেলছে। সরকার এসব অনলাইন নিউজ পোর্টালের লাগাম টেনে ধরতে পারছেনা।

সর্বশেষ গত ২ বছর পূর্বে সরকারী নির্দেশে বিভিন্ন এজেন্সী অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাগজপত্র পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছে আবেদনের প্রেক্ষিতে। দুইবছর অতিক্রম হলেও নিবন্ধনের আওতায় আসেনি এসব অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো ভাল-খারাপ বাজারে চালু থাকায় নিউজগুলো চলে যায় ফেইসবুকে। পরে চলে শেয়ারের প্রতিযোগীতা। অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু হওয়াতে এর প্রভাব পড়েছে সংবাদপত্রের উপর। সংবাদপত্র শিল্প বর্তমানে একটি রুগ্ন শিল্পে পরিনত হয়েছে।

অনেক বহুল প্রচারিত পত্রিকার সার্কুলেশন কমে এসেছে। হকারের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। হকারেরা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। সংবাদপত্র এজেন্টরা ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। টিভি চ্যানেল, দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাও অনলাইন সংস্করণ হচ্ছে। এতে করে স্মার্ট ফোনে মানুষ পত্রিকা হাতের মুঠোয় পড়ে নিচ্ছে। প্রতিটি সংবাদ তাৎক্ষণিক পাচ্ছে মোবাইলে। এরপর পত্রিকা পড়ার আর আগ্রহ পাঠকের থাকেনা। এতে করে সংবাদপত্র এখন পাঠকের হাতে যাওয়া অনেক কমে গেছে।

যে পাঠক অনলাইনে সংবাদ পড়েন তারা পত্রিকা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সংবাদপত্র মালিকেরাও অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালান। শহরে ও গ্রামে এখন ইন্টারনেট চালু থাকায় মানুষ সহজে হাতের মোবাইলে সব তথ্য তাৎক্ষণিক অবগত হচ্ছে। আবার উদ্ভট তথ্য যেমন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে সেভাবে সমাজে বিভিন্ন অস্তিরতাও সৃষ্টি করে। রাজনীতি ও সমাজচিত্রে ভূয়া ও নাম সর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো শুধু সমাজের নয়, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি করছে।

সমাজে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেক অঘটনের রক্তপাতও করেছে এই অনলাইন। আতঙ্ক ছড়ায় এই অনলাইন। আমি নিজেও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাথে জড়িত প্রায় ৫ বছর হয়ে গেল। আমার দুই সহকর্মী অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এই অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিচালনা করছেন। অনলাইনের মধ্যে অদক্ষ, অশিক্ষিত, আনাড়ী ও সংবাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ নন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি ভালভাবে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের দিয়ে পারিচালনা করছেন।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের জরিপে পর্যবেক্ষণ করেছেন, সরকার বিরোধী একটি চক্র ভূয়া নামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি। সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোই এদের প্রধান কাজ। সেদিন এক উপজেলা থেকে পরিচালিত অনলাইন সাইটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের ছবি দিয়ে লিখেছে “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ডুবে যাওয়ার সময় উদ্ধার কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে”। অন্যদিকে সরকারী দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ছবি দিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য, টাকা আত্মসাৎসহ নানা উদ্ভট কাহিনী প্রকাশ করছে। এসব আজগুবি খবর মাঝে মধ্যে পত্রিকায়ও ছাপা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে সরকারী একটি দপ্তরের কর্মকর্তা গোপাল কৃষ্ণ দত্ত। তাকে ফোন করেন কথিত এক সাংবাদিক। তিনি ফোন করে বললেন, ভাইজান, আপনি নাকি ছাত্রজীবনে শিবিরের ক্যাডার ছিলেন, এখন জামায়াতের অর্থজোগানদাতা। সরকারী কর্মকর্তা ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠল, বললেন, ভাইজান ভূল নাম্বারে ফোন করেছেন মনে হয়। কথিত সাংবাদিক বললেন, না গোপাল বাবু আপনাকেই করেছি। গোপাল বাবু বললেন, এটা কি বললেন, আমি হিন্দু মানুষ, জামায়াত-শিবির করতে যাব কেন। ওরাইবা আমাকে কিভাবে নেবে।

এভাবে সরকারী-বেসরকারী দপ্তর, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ অনলাইনের কথিত সাংবাদিকদের উদ্ভট ফোনে হতবাক হচ্ছেন, সেভাবে সাংবাদিক পেশাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করছে নাম সর্বস্ব পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো। অনলাইনের মধ্যে সব খারাপ তা নয়, তবে বেশীরভাগই নানা রোগে আক্রান্ত। বিজ্ঞাপন নেই, পুঁজি নেই। প্রেস রিলিজ দিলে নিচ্ছে টাকা। আবার অনেকে নিজের পকেটের টাকা দিয়েও চালাচ্ছেন। তবে এদের সংখ্যা হাতেগোনা। অনলাইন দোকানদারীতে অনেকে সরকারের কাছে আবেদন করেই মনে করেছেন নিবন্ধন পেয়ে গেছেন। এখন ঠেকায় কে।

সমাজে যেমন ভাল-মন্দ মানুষ রয়েছে, তেমনি অনলাইনেও ভাল-মন্দ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নষ্টদের ভীড়ে ভাল অনলাইন পোর্টালগুলো এখন কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামে দেখা গেছে, ভাল অনলাইনেও দুই নম্বরী সাংবাদিক ঢুকে পড়েছে। এদের হামবড়া ভাব দেখলে মনে হয় তিনি নিজেই এমপি-মন্ত্রী। চট্টগ্রামে অনলাইনগুলো পর্যলোচনা করে দেখা গেছে, কোন নিউজের প্রতিবাদ আসলেে এবং তা তীব্রতর হলে অনলাইন সাইট থেকে নিউজ সরিয়ে ফেলা হয়। সরকারী এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত সপ্তাহে জানান, একটি অনলাইনে ফেইসবুক থেকে তার ছবি নিয়ে তার বিরুদ্ধে নিউজ করা হয়েছে অথচ তার কোন বক্তব্য নেওয়া হয়নি। মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করা হয়েছে।

সারাদেশের মতো চট্টগ্রামে নানা নামে অনলাইন পোর্টাল খুলেই এক একজন সাংবাদিক সেজে বসলেও তাদের কোন রিপোর্টিং বা নিউজ করতে দিলে দুই লাইন লিখতে ব্যর্থ হবে।

সেদিন এক ভ্রদ্রলোক ফোন করে বললেন, এটিএম সামসুজ্জামান নাকি মারা গেছেন? আমি খোঁজ নিয়ে তাকে জানালাম না, তিনি বেঁচে আছেন। তবে অসুস্থ। এভাবে এটিএম সামসুজ্জামানকে দশ থেকে পনর বার অনলাইন মৃত্যু ঘটিয়েছে। কোন কোন অনলাইন পোর্টালগুলো সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এসব অনলাইনের লাগাম ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোন যোগ্যতা ছাড়াই এক একজন অনলাইনের সাংবাদিক।

নিবন্ধনের আওতায় সচ্ছ অনলাইন পোর্টালগুলোকে নিয়ম, নীতি ও নীতিমালা ও সাংবাদিকতার সঠিক পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করা উচিত। ইচ্ছামতো তথ্য অনলাইন সেটে দিয়ে আবার ইচ্ছামতো অপসারণ করাসহ নানা অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। ইদানিং দেখা গেছে, অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল মেয়র, এমপি ও মন্ত্রিদের পক্ষে সাফাই গাইতে ও মালিশের মাত্রা অতিক্রম করতে।

অনলাইন নিউজ পোর্টালে শুধু যে সংবাদের ছড়াছড়ি তা নয়, অশ্লীল তথ্যও ছড়ানো হয়। এমনকি ব্যক্তি বিশেষের চরিত্র হনন করতে ফেইসবুক থেকে ছবি নিয়ে কাল্পনিক তথ্য প্রকাশ করে অনেক জনপ্রতিনিধি ও সমাজে দায়িত্বশীল মানুষের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। সভ্যসমাজে সভ্যতার মাপকাঠিতে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো সমাজে যেভাবে অগ্রগতির পথকে সুগম করবে সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিভ্রান্ত করছে এসব আনাড়ীহাতের পরিচালিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো।

অনলাইন বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর সম্পাদক, প্রকাশককে অনলাইনে নিয়মিত আপগ্রেড করার অঙ্গিকার ও অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের জন্য আইনের আওতায় আনার অঙ্গিকারসহ প্রতিবেদক ও কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়ার মতো সামর্থ না থাকলে তাদের নিবন্ধন না দেওয়া প্রয়োজন। কারণঃ নাপিতের বাক্সের মতো খুলেবসা দোকানদারীতে বেচাকেনার অর্থ দিয়ে বেতনভাতার যোগানদাতাদের হাতে নিবন্ধন গেলে এই নিবন্ধন নিয়ে আরেক রকম ‘বাণিজ্য’ করার আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞজনেরা।

এই বাণিজ্যের ব্যাপারে নামসর্বস্ব এক অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক বললেন, বাসায় আমি যতক্ষণ থাকি অনলাইনে এদিক সেদিক থেকে অর্থাৎ অন্য অনলাইন পোর্টাল থেকে নিউজ এনে শিরোনাম বদলিয়ে আমার নাম দিয়ে ছেড়ে দিই। আমি বাসায় না থাকলে আমার স্ত্রী ও মেয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালায়।

এভাবে অনলাইন নিউজ পোর্টাল যেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে দেশে কোন ধরনের নিয়মনীতি ছাড়াই। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, নিগৃহিত হচ্ছে। অপমানিত হচ্ছে ভূয়া তথ্যে। ব্যাংক ডিপোজিটের অংক সন্তোষজনক রেখে ও প্রতিবেদক ও কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়ার সক্ষমতা যাচাই বাছাই করে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন করেছেন ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট মহল। বড় অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর থেকে নিউজ টেনে “কাটপিস সর্বস্ব” নিউজের ছড়াছড়ি বেশীরভাগ অনলাইন নিউজ পোর্টালে। এতে করে তথ্য বিভ্রাট ও জঞ্জাল সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.