ভক্ত, পূর্ণার্থী ও সন্নাসীদের মিলনমেলায় পরিণত বাঁশখালীর ঋষিকুম্ভ মেলা

0

দিলীপ তালুকদার/কল্যাণ বড়ুয়া মুক্তাঃ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বাঁশখালী ঋষিধামে আজ দশম দিনে বিশ্ব কল্যাণে গীতা যজ্ঞের মাধ্যমে শেষ হলো আন্তর্জাতিক ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলা। বর্ণাঢ্য মহাশোভাযাত্রার মাধ্যমে গত ৩১ জানুয়ারি ১০ দিন ব্যাপী বিংশতম আন্তর্জাতিক ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলা শুরু হয়।

আজ রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারী) ছিল মেলার দশম দিন। এ দিনে চলছে অহোরাত্র মহানাম সংকীর্তন। আজ রবিবার মেলার দশম ও শেষ দিনে মঙ্গল আরতি ও ষোড়শ প্রহরব্যাপী মহা নামযজ্ঞের পূর্ণাহুতি, গঙ্গাপূজা ও মহাস্নান, বিশ্ব কল্যাণে গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়।

মেলার প্রথমদিনে মহাশোভাযাত্রার পৌরহিত্য করেন চট্টগ্রাম তুলসীধাম ও বাঁশখালী ঋষিধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজ। মহাশোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন দেশ হতে আগত সাধু সন্ন্যাসীগণ।

মেলার শুরু থেকেই প্রতিদিন ঢল নামে হাজার হাজার পূর্ণার্থীর। মেলা উপলক্ষে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত সন্ন্যাসীরাও ভিড় জমিয়েছেন। প্রতিদিনই রুপ নিয়েছে ভক্ত, পূর্ণার্থী ও সন্নাসীদের মিলনমেলায়।

বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর ইউনিয়নের কোকদণ্ডী গ্রামের ঋষিধামের ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলায় আজ শেষ দিনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ঋষিধাম মন্দিরে চলছে বিশ্ব কল্যাণে ভূবন মঙ্গল গীতাযজ্ঞ। মন্দিরে ঢোকার মুখে পাশের মাঠে বসেছে মেলা। পাশেই চলে দুর দুরান্ত থেকে আগত ভক্তদের জন্য প্রসাদ আস্বাদনের বিশাল আয়োজন। কুম্ভমেলাকে কেন্দ্র করে পুরো বাঁশখালী জুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। ব্যাপক যানজট উপেক্ষা করে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ভক্তরা গেছেন ঋষিধামে।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ভারতের চারটি স্থানে কুম্ভমেলা হয়। এগুলো হলো হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক ও উজ্জয়িনী। তিন বছর পর চক্রাকারে চারটি স্থানে কুম্ভমেলা বসে। সে হিসেবে একেকটি স্থানে ১২ বছর পরপর এই মেলা ঘুরে আসে। বাংলাদেশে একমাত্র বাঁশখালীর ঋষিধামেই তিন বছর পরপর এই মেলার আয়োজন করা হয়।

মেলায় কথা হয় বিংশতম আন্তর্জাতিক ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলা উদ্যাপন পরিষদের আহবায়ক দেবাশীষ পালিতের সাথে। তিনি মেলা সুন্দর ও শান্তিপুর্ণভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় কমিটির পক্ষ থেকে সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করায় কোন বিশৃঙ্খলা ছাড়াই মেলা আজ শেষ হলো। তবে আগামীদিনও অনুষ্ঠিত হবে দীক্ষাদান কর্মসূচী।

তিনি জানান, যাঁরা দূরদূরান্ত থেকে ভারতের এই চারটি স্থানে গিয়ে তীর্থ করতে অক্ষম, তাঁদের কথা বিবেচনা করে বাঁশখালী ঋষিধামের প্রতিষ্ঠাতা মোহন্ত শ্রীমৎ অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ ১৯৫৭ সাল থেকে এখানে কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেছিলেন। ভারতের চারটি স্থানের যেকোনো একটি মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পর বাংলা মাঘ মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে ঋষিধামে কুম্ভমেলা বসে।

তিনি আরো বলেন, প্রতিবারই ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক সন্ন্যাসী আসেন। এটি এক মহা মিলনমেলা। মেলা উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে অর্ধশতেরও বেশি সন্ন্যাসী এসেছেন।

মন্দিরে আগত কয়েকজন সন্ন্যাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কুম্ভ মানে কলস। অমৃতের কলস। অমরত্ব লাভের আশায় একবার দেবতাদের সঙ্গে অসুরকুলের সমুদ্রমন্থন হয়েছিল। সমুদ্রমন্থনের ফলে উঠে এল বহু মূল্যবান সামগ্রী। উঠল একটি অমৃতের ভাণ্ড। অসুরদের এই অমৃতকুম্ভ না দেওয়ার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত একসময় সেটি নিয়ে গেলেন।

নিয়ে যাবার সময় অমৃত ভাণ্ডার রাখা হয়েছিল চারটি স্থানে। হরিদ্বার, প্রয়াগ, ত্রিম্বকেশ্বর-নাসিক ও উজ্জয়িনী এই চারটি স্থানে কলস থেকে কয়েক ফোঁটা অমৃত রস পড়েছিল বলে ধারণা। তাই এই চারটি স্থানে অমৃত সুধারস আস্বাদনের জন্য বসে কুম্ভমেলা। এগুলো তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।

মেলা উপলক্ষে প্রতিদিনই চলেছে নানা অনুষ্ঠান। ১০ দিন ধরে মন্দির প্রাঙ্গণে শোভাযাত্রা, দেব-দেবীর পূজা, চণ্ডীযজ্ঞ, গঙ্গা স্নান, ঋষি সম্মেলন, ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠান, ধর্ম মহাসম্মেলন এমন নানা আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বাঁশখালীর জনপদ। অংশ নেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা ঋষি-সন্ন্যাসীরা।

আন্তর্জাতিক বিংশতম ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলায় লাখো পূর্ণ্যাথীর অংশগ্রহনে ছিল মুখর। চট্টগ্রাম তুলসীধাম ও ঋষিধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজসহ ভারতের বৃন্দাবন থেকে আগত শ্রীমৎ ধনঞ্জয় দাসজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী স্বরুপানন্দ শাস্ত্রিজি মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী সঞ্জয় গিরি মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী নীলমনি মহারাজ, শ্রীমৎ ভাগবদ্ দৈবজ্ঞ বাণী জ্যোতিষ সংস্থানের আচার্য্য শ্রী গোপাল কৃষ্ণ মহারাজ ও রাশিয়ার ইউক্রেন ভক্তিবেদান্ত গীতাশিক্ষা সেন্টারের ভাইস প্রিন্সিপাল শ্রী অর্চ্চম কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, শ্রীমৎ স্বামী সঞ্জয় গিরি মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী নীলমনি মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী রননাথ ব্রক্ষাচারী, শ্রীমৎ স্বামী উপানন্দ ব্রক্ষাচারী, শ্রীমৎ স্বামী রবিশ্বানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী অনঘানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী প্রবোধানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী উজ্জ্বল ব্রক্ষাচারী, শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দ মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী পরিতোষানন্দ ব্রক্ষাচারী, শ্রীমৎ অজয়াপানন্দ ব্রক্ষচারী মহারাজ,শ্রীমৎ স্বামী প্রদীপানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ সম্ভুনাথানন্দ পরমহংস, শ্রীমৎ প্রেমময়ানন্দ ব্রক্ষাচারী, শ্রীমৎ দিব্য চৈতন্য, শ্রীমৎ রন্িজতানন্দ পুরী, শ্রীমৎ কৃঞ্চ চৈতন্য ব্রক্ষচারী, শ্রীমৎ আদেশ ব্রক্ষচারী,শ্রীমৎ স্বামী অক্ষরানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ হরি কৃপানন্দ পুরী মহারাজ শ্রীমৎ রামানন্দ পুরী মহারাজ,ঋষিদের সান্নিধ্য পেতে দলে দলে ভক্তরা মেলায় এসে তাদের ধুলা ও আর্শীবাদ গ্রহন করেছে ।

অপরদিকে কুম্ভমেলা উদ্যাপন পরিষদের আহবায়ক ও রাউজান পৌরসভার মেয়র দেবাশীষ পালিত্ নেতৃত্বে এডভোকেট তপন কান্তি দাশ, বিমল কান্তি দেব, ঋষিকুম্ভ মেলা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব এডভোকেট অনুপম বিশ্বাস, শিল্পপতি অলক দাশ, অজিত কুমার দাশ, অধ্যাপক দেবব্রত দেওয়ানজী, এডভোকেট ভূপাল কান্তি গুহ, চন্দন দাশ, ঋষিকুম্ভ মেলা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব শ্যামল কান্তি দাশ, তাপস কুমার নন্দী, অলক দাশ, কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আ.ন.ম. শাহাদাত আলম, ডা. আশীষ কুমার শীল অর্থ সচিব তড়িৎ কান্তি গুহ, এডভোকেট কাঞ্চন বিশ্বাস, ডা: কথক দাশ,বাঁশখালী পুজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি প্রদীপ গুহ, ছোটন কান্তি দেব, রাজীব গুহ, দিলীপ দত্ত, নন্দন শীল, পলাশ দাশ, পান্না পাল, শোভা রানী ধর, নারায়ন মল্লিক, দোলন দাশ, বিশ্বজিৎ দত্ত বাবু,নিপুন দেবনাথ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ দুরাগত অতিথিদের সাথে শুভেচ্ছা বিমিয় এবং মেলার সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করেছে সর্বাত্মকভাবে ।

এর আগে ঋষিকুম্ভ মেলা উপলক্ষে মঙ্গল আরতি ও জয়গানে মঙ্গল আহ্বান, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, তৈজস সামগ্রী সহকারে ভান্ডারগৃহের উদ্বোধন, মহাশোভাযাত্রা, গুরু মন্দিরে শ্রীগুরু বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও মন্দিরের মাঙ্গলিক কাজের উদ্বোধন, গুরু মহারাজের পূজা, ভোগরাগ ও সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও ধর্মসম্মেলন ও সঙ্গীতাঞ্জলি, সন্ধ্যারতি ও সমবেত প্রার্থনা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, গীতাপাঠ প্রতিযোগিতা, সঙ্গীতাঞ্জলি, চণ্ডীযজ্ঞ, ভগবান শ্রী বিষ্ণুর অভিষেক, সংগীতাঞ্জলি, ধর্ম মহাসম্মেলন, দেবাদিদেব মহাদেব’র অভিষেক, সংগীতাঞ্জলি, ধর্ম মহাসম্মেলন, নাটক যুগাবতার পরম পুরুষ স্বামী অদ্বৈতানন্দ, দশমহাবিদ্যা পূজা, ধর্মীয় সংগীতাঞ্জলি, স্বামীজি রচিত শ্রী শ্রী দশমহাবিদ্যা অনুসরণে ধর্ম মহাসম্মেলন, গঙ্গা পূজা ও মহাস্নান, ঋষিধ্বজা উত্তোলন, বেদমন্ত্র পাঠ, ১০৮ দীপমণ্ডিত মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, সাধু ভাণ্ডার ও আন্তর্জাতিক ঋষি সম্মেলন, গঙ্গারতি ও অদ্বৈতানন্দ সরোবরে দীপদান উৎসব, সমবেত প্রার্থনা, অষ্টপ্রহরব্যাপী মধুসুদন কীর্তনের শুভ অধিবাস, চতুষ্প্রহরব্যাপী অহোরাত্র কীর্তন, রাধাকৃষ্ণের অভিষেক, সংগীতাঞ্জলি, ধর্ম মহাসম্মেলন, ষোড়শ প্রহরব্যাপী মহানাম যজ্ঞের অধিবাস, ষোড়শপ্রহর ব্যাপী মহানামযজ্ঞের শুভারম্ভ ও অহোরাত্র নামসংকীর্তন, গঙ্গাপূজা ও মহাস্নান, সপ্তশতী তুলসীদান, বিশ্বকল্যাণে পঞ্চাঙ্গ স্বস্থ্যয়ন, শান্তি হোম ও অঞ্জলি প্রদান, অন্নকূট উৎসব, গুরু মহারাজের ভোগরাগ ও সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানমালায় পৌরহিত্য করেছেন ঋষিধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী। বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে অংশ নেওয়া লাখো পুণ্যার্থীদের জন্য প্রতিদিন দুপুর ও রাতে ছিল মহাপ্রসাদ ও অন্ন প্রসাদ। বসেছে মেলা প্রাঙ্গণেও বসেছিল লোকজ পণ্যের বিশাল পসরা। মেলায় বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র, দা-বঁটি, হাতপাখা, শিশুদের খেলনাসহ নানা পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। তবে যজ্ঞের কলা বিতরণ নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারো কিছু বিশৃংখলা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিতরণের আগে লাইন করে দিলে ভীড় ও ঠেলাঠেলি হতো না। ভীড়ের চাপে পড়ে অনেক বয়োজেষ্ঠ বিরক্ত প্রকাশ করেছেন।

 

 

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.