মৃত্যু মিছিলের ভাষা ও বেগম জিয়ার মুক্তি 

0

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী,সিটি নিউজ : সর্বোচ্চ সচেতনতার তাগিদ সর্বত্র। সরকার উদ্বিগ্ন । জনতাও গভীর উদ্বেগে। আগামীকাল ২৬ মার্চ থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ টানা দশদিন।সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার ।বৈশ্বিক করোনা দুর্যোগ বাংলাদেশকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে।

তিন মাস আগে চীনের ওহানে ধরা পড়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। এটি ঠেকাতে বাংলাদেশের প্রস্তূতিতে আছে বিলম্বের অভিযোগও। করোনার বিস্তার তিন মাসে ২০০ দেশ ছুয়েছে। দ্রুতবেগে বাড়ছে মৃতের হার। টিকা বা প্রতিরোধক আবিষ্কার না হওয়ায় দীর্ঘ হচ্ছে বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুর নীরব মিছিল।

সময় এখন এতটাই সঙ্গীন যে, কাব্য পঙতিও বদলে যায়। তারুণ্যের কবি হেলাল হাফিজের পঙতি পাল্টে দিলেন টাইগার লিডার, সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা ।

হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান পাক হানাদারের ‘ম্যাসাকার’ থেকে। বীর বাঙালির অনন্য শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।এই কবি শুধু সেই যুদ্ধেই ছিলেন না,ছিলেন সত্তরের জাগরন, আশি-নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সংগ্রামেও। তারুণ্যকে জাগাতে তিনিই লেখেন,

“এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাবার তার / শ্রেষ্ঠ সময়, /
এখন যৌবন যার / মিছিলে যাবার তার / শ্রেষ্ঠ সময়..”

কবির এসব পঙতি বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক সফল অধিনায়ক মাশরাফি।মাশরাফি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি । তবে করোনার যে ভয়াবহ বিস্তৃতি এবং তার বিপরীতে মানুষের যে বাঁচার তাগিদ, তা যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয় ।অনেকেই একে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলছেন । আর এই যুদ্ধ পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, অনুজীব কিংবা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

অস্ত্র গোলাবারুদ ছাড়াই যে প্রকৃতি তার সৃষ্টিকুলের সাথে লড়তে পারে, এটি তারও প্রমাণ। এরকম যুদ্ধে নিজস্ব সতর্কতার পাশাপাশি প্রধানত প্রকৃতি ও তার সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।

এমন যুদ্ধ স্রষ্টাকে ডাকার স্বাভাবিক রীতিও বদলে যাওয়ার মত।’শব ই মেরাজ’ এও মসজিদ হয়ে পড়ে প্রায় মুসল্লী শূণ্য। মাজারে ছিল না অন্যবারের মত স্বাভাবিক মোমের আলো-আতরের ঘ্রাণ। মন্দির গির্জা প্যাগোডায় ভীড় নেই। প্রায় প্রত্যেকেই যেন নিজ ঘরে এখন ‘স্বেচ্ছাবন্দি’। অথচ এমন নবতর যুদ্ধেও অনেকেই সৃষ্টির স্রষ্টাকে ভুলে যান।

মজুদদারি মুনাফাখোরী করতেই থাকেন । অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক আছেন, যারা অবিবেচকের মত প্রতাপ ক্ষমতা আরও বাড়ান।

করোনা উদ্বেগে তারকা মাশরাফি বললেন ,”এখন যৌবন যার বাসায় থাকার তার শ্রেষ্ঠ সময় । এখন যৌবন যার দেশকে বাঁচানোর তার শ্রেষ্ঠ সময়। ”

বিশেষ করে ঘরের কর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাশরাফি বলেন, “আপনি যদি আপনার ঘরের ক্যাপ্টেন্সি ঠিক রাখতে পারেন, তবে আমরা নিশ্চয়ই এ সংকটে দেশকে বাঁচাতে পারবো। আপনি নিজে ঘরে থাকুন। নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন। পরিবার, সমাজকে সুরক্ষিত রাখুন। এই দায়িত্ব আমার, আপনার সবার। ”

মাশরাফির এমন সতর্কবাণীর সাথে বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হকের বক্তব্যে এসে কেমন যেন ছন্দপতন হয়।

সরকারি-বেসরকারি নানা সর্তক পদক্ষেপ সত্বেও পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে সংকট চরমে। একদিকে বিদেশি ক্রেতার কার্যাদেশ বাতিল ,অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ পোশাক প্রস্তুতকারক শ্রমিক আছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। অথচ এই খাতেও বিদেশী ক্রেতারা গত ৭০/৮০ দিনে দফায় দফায় এসেছেন বাংলাদেশে। তাদের সূত্রে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আছে । আবার এসব শ্রমিকের সেই ঝুঁকির প্রভাব থাকতে পারে সংশ্লিষ্ট বা প্রতিবেশীদেরও।

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের ইপিজেডগুলোর কারখানাগুলোতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এখনো কাজ করছেন। কারখানাগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিবেশের কথা বাদ দিলেও এইসব শ্রমিকের গমনাগমন পথে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বিগ্ন।

প্রশ্ন উঠেছে,‘তবে কি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি ঘোষণা করে তাদের বেতন ভাতা দেবে বিজিএমইএ?-এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে কারখানা মালিকদের সংগঠন চেয়ে আছে সরকারি সহযোগিতার দিকেও।প্রশ্ন আছে আরো, এসব শ্রমিকদের শ্রম, মেধা ও জীবনের সোনালী সময়কে ব্যবহার করে যেসব মালিক কোটি কোটি ডলার আয় করেন, তারা কি এই দুর্যোগে সরকারি সহযোগিতা ছাড়া শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে পারেননা? সরকার তো এমনিতেই তাদের নানামাত্রিক প্রণোদনা দিয়ে চলেছে ।

তাছাড়া এই সংকটে কার্যাদেশ দেয়া বিদেশি ক্রেতারা কি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবেন না ? যদি পাশেই না দাড়ান, সেই সহযোগিতা আদায়ে ব্যর্থতার দায় কি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন’র নেই ? তবে কি শ্রমিকদের সর্বোচ্চ দিয়ে কেবল মালিক ও বিদেশী ক্রেতাদের পুঁজিপতি থেকে মহাপুজিপতি বানানোর কাজ’ই এতদিন হল ? কোথায় গেল এইসব বিশ্বমোড়ল রাষ্ট্রের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মানবিকতা ?’ এমন অবস্থায় বিজিএমইএ’ র রুবানার বক্তব্য অবশ্য হতাশ’ই করল।

বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এবং ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। ব্যবসায়ী নেতা আনিসুলের স্ত্রী হিসেবে শুধু নয়, রুবানার রয়েছে সকীয় অবস্থান। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সামগ্রিক পর্যালোচনায় আশাবাদের কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া গেল না।

শ্রমিকদের সবেতনে ছুটিতে পাঠানোর প্রশ্নে বিজিএমইএ সভাপতি যেন অনেকটা উত্তেজিত হয়েই উঠলেন গতকাল একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের টকশোতে। করোনার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে এও বললেন, ‘লন্ডনে ডাক্তারদের হাতের গ্লাভসও নেই’ । লন্ডনে অবস্থানরত নিজের মেয়ে জামাই’র তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি এ বক্তব্য দেন।

‘বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত মালিকদের কারখানাগুলোর প্রতিটিতে ঝুঁকিমুক্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে’ বলেও দাবি করে বললেন, ‘বিদেশি ক্রেতারা তাদের ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ বাতিল করেছেন।’ এমন অবস্থায় শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্তি অব্যাহত রেখে কারখানাগুলো সাময়িক বন্ধ রাখার প্রস্তাব নাকচ করেন তিনি। ‘এরকম দায়িত্ব নিতে পারবেন না’ বলেও জানান সংগঠনটির সভাপতি।রুবানার দাবি, ‘বিজিএমইএ তাঁর একক সিদ্ধান্তের নয়, এটি হল পোষাক প্রস্তুতকারী মালিকের সংগঠন। তাই কারখানা বন্ধ করার এখতিয়ার সংগঠন সভাপতি হিসেবে তাঁর নিজের নেই, এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে মালিকদের প্রত্যেককে নিজস্ব অবস্থান থেকেই নিতে হবে।’

সরকার তাঁদের জন্য কি সহায়তা দিচ্ছে, সেটি দেখতে ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষনে কী বলছেন, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান রুবানা। ‘৭১ টিভি’র সাথে টকশোতে সংযুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

তবে তাঁর কথায় করোনার বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ পূর্বাপর পরিস্থিতিতে যে গভীর অন্ধকারের টানেল, তার শেষের কোন আলোর দেখার আভাস’ই মিললো না। অবশ্য তবুও সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে দৃশ্যত রুবানার বক্তব্যে বাংলাদেশের বাস্তবতা যথার্থই।

কারণ এদেশে মালিক-শ্রমিক উভয় সংগঠনেই আছে কিছু নরকের কীট। হয়তো তাদের কারণেই নিজের সীমাবদ্ধতার কথাই প্রকারান্তরে স্বীকার করলেন রুবানা ।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের এমন দশা’ই যেন সারা বাংলাদেশের চিত্র প্রতিভাত ! গার্মেন্ট শ্রমিকরা যেন এই নজিরবিহীন মানবিক বিশ্ব দুর্যোগে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা অরক্ষিত চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার লক্ষ-কোটি মানুষ তথা অরক্ষিত দেশবাসীর প্রতিভূ।

করোনায় বদলে গেল চেনা চিত্র। সড়কে আগের মত ভিড় নেই। শপিং মলে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নেই। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ মার্কেট । সচেতন মানুষ মুখে মাক্স, হাতে গ্লাবস পড়েছেন। খানিক পরপর সেনিটাইজারে হাত মোছা অব্যহত রেখেছেন। এমন সতর্কতার মধ্যে লুটেরা শ্রেণি সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অব্যাহত প্রতিযোগিতার উৎকণ্ঠা আছেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারী সিদ্ধান্তে কাজ শুরু করেছে সশস্ত্র বাহিনী।

এরকম একটি অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার ছোট বোন ও তাঁর স্বামী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পরে এসেছে নতুন সিদ্ধান্ত, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে খানিকটা স্বস্তি ও আশাবাদের সৃষ্টি করেছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে মুক্তির। ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ দুর্নীতি মামলায় সাজা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন মুক্তি দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, মানবিক কারণে বয়স বিবেচনায় সরকার সদয় হয়ে বেগম জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমতিতে সরকার এ ঘোষণা দিয়েছেন’ বলেও জানান আইনমন্ত্রী।

অন্যদিকে গতকাল এ লেখা লেখা পর্যন্ত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল কিংবা অন্য নেতারা কেউ’ই তাৎক্ষণিক এই আদেশকে স্বাগত জানাননি।মির্জা ফখরুল অবশ্য বলেছেন, সরকারের ‘অর্ডার কপি’ দেখে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে বক্তব্য জানাবেন।

বেগম জিয়ার মুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বিএনপির অভ্যন্তরে কিংবা সমগ্র রাজনীতিতে কীরকম দোলাচল তোলে, সেই বিবেচনা পড়ে।

রাজনীতিতে মারি ও মড়কের ভাষা যে যেভাবেই বুঝুননা কেন, এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক দিকটি প্রশংসাযোগ্য । সাধারণ মানুষের এখন প্রত্যাশা, বিভক্তির রাজনীতিকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীরা জোটবদ্ধভাবে করোনায় সৃষ্ট এই বৈশ্বিক মানবিক সংকট মোকাবেলায় কাজ করবেন । এটিই এখন সময়ের দাবি।

লেখক: সহ-সভাপতি, বিএফইউজে- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাধারণ সম্পাদক, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রাম।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.