কক্সবাজারে লবণ ব্যবসায় করোনার থাবা-ন্যায্য মূল্য না পেয়ে মাঠ ছাড়ছে চাষীরা

0

চকরিয়া (কক্সবাজার) থেকে বশির আলমামুনঃ দেশের সর্বোচ্চ লবন উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজার জেলায় এবার লবণ ব্যবসায় ধস নেমেছে। এমনিতেই মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণের দাম দীর্ঘদিন ধরেই নিম্নমুখী। তার উপর আবার বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারী নির্দেশনা মেনে মানুষকে ঘর মুখো হতে হচ্ছে।

এতে পরিবহন সংকট ও কারখানা বন্ধ থাকা সহ নানা সমস্যায় পড়ে লবণের দাম একেবারেই সর্বনিম্নে নেমে চলে এসেছে। এমন পরিস্থিতে জেলার উপকুলীয় টেকনাফ, চকরিয়া, মহেষখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও সদর উপজেলার চাষীরা লবনের ন্যায্য মুল্য না পেয়ে মাঠেই লবণ ফেলে চলে যাচ্ছে।

বর্তমানে এসব উপজেলায় হাজার হাজার মন উৎপাদিত লবন মাঠেই পড়ে রয়েছে। লবন বিক্রি করতে না পেরে চাষীরা এখন লোকসানে পড়েছে। এ কারনে চরম অর্থ সংকটে পড়ে দায়-দেনা এড়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চাসীদের। সংকট থেকে উত্তরণে অনেকে মজুদ করে অপেক্ষার পরামর্শ দিলেও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলার হাজার হাজার চাষী এখন সংকটে দিন পার করছেন।

চাষীরা জানায় গত কয়েক বছর ধরেই মাঠ পর্যায়ে লবনের দাম নিম্নমুখী। দাম কমে যাওয়ায় কম দামে লবণ বিক্রি করে উৎপাদন খরচ পুষিয়ে উঠতে না পেরে লোকসানে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন লবণচাষীরা। অন্যদিকে চলমান নভেল করোনাভাইরাস সংকটের কারণে মিল মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।

এসব কারণে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা লবনে পুঁজি বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারিয়েছেন। তারা লবন ক্রয় বন্ধ রেখেছেণ। ফলে অনেক কৃষক মাঠে লবণ রেখেই সরে যাচ্ছেন। চলমান তাপদাহের পর যেকোনো সময় বৃষ্টিপাত হলে মাঠের লবণ নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য চাষীদের হয় এখনই এসব লবণ বিক্রি করে দিতে হবে, নয়তো মাঠেই গর্ত করে পলিথিন দিয়ে মজুদ করে রাখতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এর জন্যও আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন, যে ধাক্কা এখন আর নিতে পারছেন না চাষীরা।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার নতুন বাজার এলাকার লবণচাষী মো. আবু বকর বলেন তিনি নয় বছর ধরে লবণ চাষের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু গত তিন বছরে অস্বাভাবিক লোকসানে পড়ে প্রায় সব পুঁজিই হারিয়েছেন। দেনা পরিশোধ ও জীবিকার তাগিদে এবারো ২৫০ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছেন। ব্যয় হয়েছে কানিপ্রতি ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে।

লবণ উৎপাদনও হয়েছে অনেক। কিন্তু দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বিক্রি করতে পারছেন না। কানি প্রতি লবণের দাম পাচ্ছেন গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা করে। অর্থাৎ এবারো তার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ মাঠে পড়ে আছে। ক্রেতা না থাকায় এসব লবণ সংরক্ষণের জন্য পলিথিন কিনতে হবে তাকে। এক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়বে কানিপ্রতি ৬ হাজার টাকা করে। এছাড়া শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য নতুন করে বিনিয়োগও করতে হবে। এ অবস্থায় উৎপাদিত লবণ মাঠেই ফেলে ব্যবসা থেকে সরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই তার। একই অবস্থা মহেশখালীর মো. আবদুল কাদের, এহসান, আবুল হোসেন, জসিমসহ কয়েকশ লবণচাষীর।

চকরিয়ার বদরখালী, দরবেশকাটা, ডেমুশিয়া ও খুটাখালীর একাধিক লবণচাষী জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র পরিসরে যারা লবণ চাষ করেছেন, তাদের অনেকেই উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে পারেননি। পাওনাদারের টাকা ফেরত দিতে না পেরে তাদের কেউ কেউ মাঠে লবণ রেখেই চলে গেছেন। বদরখালীর শাহ্ আলম, কবির নামের স্থানীয় দুই কৃষক মাঠে লবণ রেখে সরে পড়েছেন এক সপ্তাহ আগে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরো অনেক কৃষককে একই পথ ধরতে হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের লবন ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন জানালেন ঠিক একই কথা। দাম কমে যাওয়ায় তার ৩০০ কানি জমির লবন মাঠেই পড়ে রয়েছে। ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছেনা মিল বন্ধ থাকায় বোটে কওে চট্টগ্রাম বা ঝালকাটি নেওয়া যাচ্ছেনা।

ইসলামপুরের লবণ ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ২৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় প্রতি সপ্তাহে দু-ট্রাক করে লবণ বিক্রি করা হতো। গত কয়েক বছর থেকে ওই পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ এখন বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণ ব্যবহার করছে কারখানায়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), লবণচাষী ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত লবণচাষীর সংখ্যা ৩০ হাজার ৬০০। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১৪০ টাকা দামে লবণ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। যদিও বিসিকের হিসাবে গড় দাম হচ্ছে ১৫৩ টাকা। অথচ প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা। সর্বশেষ তিন বছর আগে লাভে লবণ বিক্রি করেছিলেন চাষীরা। সে সময় লবনের সর্বোচ্চ দাম পেয়েছিলেন চাষীরা। কিন্তু এরপর থেকে প্রতিবারই লোকসানে লবণ বিক্রি করছেন তারা।

বর্তমানেও কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব রোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়া ও ভাড়া বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মিলে লবণের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে এবার লবণের দাম অস্বাভাবিক কমে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাপারীরা লবণ ক্রয় করলেও কৃষকদের নগদ টাকা দিতে পারছেন না। এ কারণেও অনেকে বড় ধরনের লোকসান দিয়েও লবণ বিক্রি করতে পারছেন না।

বিসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, চলমান নভেল করোনাভাইরাসের সংকটে চাষীরা লবণের ভালো দাম পাচ্ছেন না। সারা দেশের শিল্প-কারখানা পুরোদমে চালু হলে লবণের দাম আবারো সহনীয় পর্যায়ে উঠে যাবে। উৎপাদন খরচ তুলে আনা ও লাভের মুখ দেখা পর্যন্ত কৃষকদের অপেক্ষা করতে হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আমরা এরই মধ্যে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ ও এনজিও থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে দিতে তৎপরতা চালাচ্ছি। শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনে লবণের দাম স্ট্যান্ডার্ড পর্যায়ে নির্ধারণের সুপারিশও করা হয়েছে। আশা করছি, চলমান বাণিজ্যিক সংকট কেটে গেলে লবণচাষীরাও লাভের মুখ দেখবেন।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন। ৫৭ হাজার একর জমি থেকে এরই মধ্যে (২৮ মার্চ পর্যন্ত) ৮ লাখ ৮৩ হাজার টন লবণ উত্তোলন হয়েছে। ২০১৯ সালে ৬০ হাজার একর জমিতে ১৮ লাখ টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন।

চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট এলাকার মেসার্স মালেক সল্টের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল মালেক বলেন, দেশে লবণ আমদানির নামে সোডিয়াম সালফেটের অবাধ ব্যবহারের কারণে স্থানীয় উৎপাদনকারী চাষী ও প্রকৃত মিলমালিকরা লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। দেশী লবণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে, যা নিত্যপণ্যটির বাজারকে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মুখে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.