চট্টগ্রামে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, সরকার ও প্রশাসন নির্বিকার

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রামে মানুষের জীবন নিয়ে একপ্রকার ছিনিমিনি খেলছে চিকিৎসকরা। একদিকে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতাল ও কতিপয় চিকিৎসকদের করোনা চিকিৎসায় ঘোরতর অনিহায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামবাসী। হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে অনিহা, আইসিইউ, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সংকট, ওষুধের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি, ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি, প্রথমে ছিল মাস্কের কৃত্রিম সংকট সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে চলছে একরকম হাহাকার। অক্সিজেন নিয়ে চলছে নৈরাজ্যকর অবস্থা। এতে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, সরকার প্রশাসন নির্বিকার।

প্রথম ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে। চট্টগ্রামে তখনও করোনার প্রকোপ তেমন ছিল না। চট্টগ্রামে প্রথম করোনা শনাক্ত কয় ৩ এপ্রিল। সেখান থেকে গোটা মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ জনে। কিন্তু মে মাসে এসে সেই সংখ্যা আড়াই হাজারে পৌঁছে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪১৭০। মাত্র কয়েকদিন আগে নারায়নগঞ্জকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে চট্টগ্রাম। প্রতিদিন বাড়ছে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা মতে রেড জোনের তালিকায় এসেছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি এমন একটি তালিকা প্রনয়নের কথা জানান।

তিনি বলেন, সমীক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরীর যেসব থানায় করোনা শনাক্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে সেসব থানাকে রেড় জোন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, সীতাকুন্ড ও মীরসরাই উপজেলাও হটস্পট হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। সে হিসেবে পুরো চট্টগ্রাম এখন রেড জোনের তালিকায়। তিনি বলেন, ১০০ এর উপরে যেসব থানায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে সেসব থানাকে রেড জোনে, ৯০ এর মধ্যে ইউলো জোনে, ১০ এর মধ্যে ব্লেক জোনে এবং আক্রান্ত শুন্য এলাকাকে গ্রিন জোনে রাখা হয়েছে। সে হিসেবে চট্টগ্রামের সবকটি থানা এলাকায় ১০ এর উপরে করোনা আক্রান্ত রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের ইউলো জোনের নিচে কোনো এলাকা নেই। তালিকার তথ্য মতে, নগরীর ১৬ থানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে কোতোয়ালী থানা এলাকায়।

এ সংখ্যা ৩২৪। ফলে রেড জোনে রয়েছে এলাকাটি। এরপর ২১৫জন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাঁচলাইশ থানা এলাকা। এ ছাড়া ১৮৩ জন নিয়ে খুলশী এলাকা তৃতীয়, ১৬৮ নিয়ে পতেঙ্গা চতুর্থ, ১৬৭জন নিয়ে হালিশহর পঞ্চম, ১৪১ জন নিয়ে ডবলমুরিং ষষ্ঠ, ১২৩ জন নিয়ে বন্দর এলাকা সপ্তম, ১১৪ জন নিয়ে পাহাড়তলী ৮ম, ১১২ নিয়ে ইপিজেড থানা ৯ম, ১১১ নিয়ে চকবাজার ও আকবর শাহ থানা ১০ম, ১০৬ নিয়ে চান্দগাঁও ১১তম স্থানে রয়েছে। আর ৯৯ নিয়ে বাকলিয়া ও বায়েজিদ এবং ৮৬ জন নিয়ে সদরঘাট থানা ইয়োলো জোনে রয়েছে। এ ছাড়া ঠিকানা অসম্পুর্ন চট্টগ্রামে এমন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৬ জন। চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত ৩রা এপ্রিল সর্ব প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়।

তিনি চকবাজার থানার দামপাড়া মসজিদ গলির বাসিন্দা। এরপর পাহাড়তলী, দামপাড়া পুলিশ লাইন, ক্ট্টালী, চান্দগাঁও ও চকবাজারসহ সবকটি থানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। বর্তমানে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সিটিএসবির উপ-কমিশনার আব্দুল ওয়ারিশ বলেন, প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর দামপাড়ায় ওই রোগীর বাসভবন লকডাউন করা হয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ভবন ও কাঁচা ঘর লকডাউন করা হয়েছে।

আক্রান্ত বাড়ার কারনে এবং সিএমপির জনবল সংটের কারনে ভবনগুলোতে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে নিয়মিত মনিটরিং করে লকডাউনকৃত ভবন ও কাঁচা ঘরগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। সিটি এসবি সুত্র জানায়, চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৪১৭০ জন। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিক, ডাক্তার, আইনজীবি, সাংবাদিক, চাকরিজীবীর পাশাপাশি ১৬৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। নগরীতে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭৮ জন মারা গেছেন। তম্মধ্যে ৩ জন সিএমপির সদস্য রয়েছে। সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন নগরীর পুলিশ কমিশনার মাহাবুবুর রহমান।

বিচারিক কাজে আদালতে নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই করোনা পজিটিভ হয়েছেন চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক আদালতের সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দে। এদিকে করোনার লক্ষন দেখা দেওয়ার পর হোম আইসোলেশনে গিয়েছেন অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল্লাহ কায়সারও। তিনি করোনার সময়ে গুরুত্বপুর্ন বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে করে হটস্পট নারায়নগঞ্জের পর করোনার দ্বিতীয় উপকেন্দ্র এখন চট্টগ্রাম। দ্রুত বিস্তার লাভ করছে আক্রান্তের সংখ্যা। চট্টগ্রামের নগর এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের মোট আক্রান্তের ৭৭ শতাংশই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাস করেন।

বাকি ২৩ শতাংশ বিভিন্ন উপজেলায়। করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও পরীক্ষা এবং রিপোর্ট প্রাপ্তী নিয়ে হয়রানীর অভিযোগ আসছে প্রতিনিয়ত। নগরীর সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে কোন ডাক্তার রোগী দেখছেন না। অক্সিজেন ও ভেন্টিলেটরের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনা কালে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মত বহুগুনে দাম বেড়েছে ওষুধের। ওষুধের দোকানদাররা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছে প্যারাসিটামল, ফ্লুক্লক্সসিসিলিন, সিপ্রুফ্লক্সিসিলিন, এজিথ্রোমাইসিন ও ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের টেবলেট ও ক্যাপসুলের দাম। তিনগুন থেকে চারগুন বৃদ্ধি করা হয়েছে এসব ওষুধের দাম। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করলেও দাম কমছে না।

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগজুড়ে বিরাজ করছে অরাজকতা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা কোন রোগী দেখছেন না। সবচেয়ে বেশি সাবোটাস করছে বেসরকারী হাসপাতালগুলো। করোনা রোগী সন্দেহে এরা কোন রোগীকে হাসপাতালে ডুকতে দিচ্ছে না। চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হচ্ছে ধনী-মধ্যবিত্ত সব শ্রেনীর মানুষের। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু মৃত্যু মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবারে গত ১৭ মে সন্ধ্যায় নেমে আসে কালো ছায়া। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের সুগন্ধার বাসায় ৮ সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ২২ মে রাতে এস আলম পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও শিল্পপতি সাইফুল ইসলাম মাসুদের বড় ভাই মোরশেদুল আলম চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে মারা যান। ভাইরাসটি সংক্রমনের শুরুতে ১৮ মার্চ সিঙ্গাপুরে যান ওই বাড়ির প্রধান প্রানপুরুষ সাইফুল আলম মাসুদ। সঙ্গে যান স্ত্রী ফারজানা পারভীন পপি, মেজ ছেলে আশরাফুল আলম ও ছোট ছেলে মাহির আলম। এখনো তারা সেখানেই আছেন।

বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেও মেলেনি চিকিৎসা। সময় মত চিকিৎসা না পেয়ে গাড়িতেই মৃত্যুবরন করতে হয়েছে নগরীর বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শফিউল আলম ছগীরকে। বর্ষীয়ান এই নেতার স্বজনরা জানিয়েছেন, ৯ জুন সকালে বুকে ব্যথা অনুভব করলে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পরিবেশ না পেয়ে ও আর নিজাম রোড়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান স্বজনরা। ওই প্রতিষ্ঠানের

চিকিৎসকরা করোনা রোগী সন্দেহে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ছগীরক পাশের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তাকে ফিরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে তাকে পাঁচলাইশের পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দেন তাকে। এই সময় ছগীরের স্বজনরা জালালাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল বাবুর সহায়তা চেয়ে তাকে ফোন দেন। কাউন্সিলর বিষয়টি মুঠোফোনে নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনকে জানান। পরে মেয়রের হস্তক্ষেপে ফের পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় শফিউল আলম ছগীরকে। সেখানে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলে চিকিৎসকরা জানান, শফিউল আলম ছগীর আর বেঁচে নেই। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন।

টাকার দিকে তাকায়নি আরেকটি সংকটাপন্ন পরিবার। করোনার উপসর্গ নিয়ে গুরুতর অসুস্থ দুই ভাইকে বাঁচানোর জন্য পানির মতা টাকা ঢেলেছে অক্সিজেন-ওষুধ ও হাসপাতালে। একটি আইসিইউর জন্য যত টাকা লাগে, দিতে রাজি ছিল পরিবারটি। কিন্তু না, আইসিইউ মেলেনি। একটি আইসিইউর খোঁজে পুরো চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছে তার স্বজনরা। ৮ ঘন্টার ব্যবধানে করুন মৃত্যু হলো হাটহাজারীর বাসিন্দা দুই ভাইয়ের। এই দুই ভাই পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের পুর্ব দেওয়াননগর মরহুম গোলাম রসুলের ছেলে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী মো: শাহ আলম (৩৬) ও তার ছোট ভাই হাটহাজারী বাজারের এন জহুর মার্কেটের কাপড়ের দোকানের ব্যবসায়ী মো: শাহ জাহান (৩২)।

গত ৫ জুন দুপুরে এবং রাতে তাদের করুন মৃত্যু হয়। আগামী দিনগুলো কেমন হয় চট্টগ্রামের মানুষ জানে না। উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিন কাটছে সবার। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। অটেল ধন সম্পদের মালিকরাও অসহায়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.