চট্টগ্রামে করোনার বিদ্যুৎগতি চিকিৎসা সেবায় ধ্বসঃ করুন মৃত্যু হচ্ছে মানুষের

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ রাজধানী ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে যখন করোনা ভাইরাসের শুরু হয়েছে তখন চট্টগ্রামে বইছিল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জোর প্রচারনা। নগরীতে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। সেখান থেকে গোটা মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ জনে। মে মাসে এসে আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৬৬৮০। সরকারীভাবে মৃত্যুর সংখ্য দেড় শতাধিক। বেসরকারী ও বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুন বেশি। এখন নারায়নগঞ্জকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে চট্টগ্রাম। ধনী-দরিদ্র সাধারন মানুষ, চিকিৎসক, র‌্যাব-পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধি সব শ্রেনী পেশার মানুষ এখন আক্রান্ত হচ্ছে। দ্রুত করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষেত্র বিশেষে রিপোর্ট আসার আগেই করুন মৃত্যু হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা মতে, রেড জোনের তালিকায় এসেছে চট্টগ্রাম। প্রতিদিন বাড়ছে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা। আইসিইউ’র অভাবে, হাসপাতালে-হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে এব্ং সংকটকালে ভেন্টিলেটর সুবিধা না পাওয়ায় মৃত্যু হচ্ছে মানুষের।

করোনাকালে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বহুগুনে দাম বেড়েছে ওষুধের। ওষুধের দোকানদাররা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছে সর্দি-কাশি ও গলাব্যথার সাধারন ওষুধের মুল্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করলেও দাম কমছে না। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগজুড়ে ভেঙ্গে পড়েছে চেন অব কমান্ড। উপজেলা কিংবা জেলা শহর কোথাও ডাক্তাররা রোগী দেখছেন না। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেছেন একাধিক চিকিৎসক। এতে করে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। করোনা রোগী সন্দেহে রোগীকে হাসপাতালে ডুকতে দিচ্ছে না বেসরকারী হাসপাতালগুলো।

এতে করে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। চিকিৎসা না পেয়ে নির্মম মৃত্যু হচ্ছে ধনী-মধ্যবিত্ত সব শ্রেনীর মানুষের। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারে সেবা দিতে অপারগতায় চিকিৎসক সহ ১১ জনকে অব্যাহতি দিয়েছে মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। অব্যাহতি প্রাপ্ত মেডিকেল অফিসাররা হলেন ডা. সিদ্ধার্থ শংকর দেবনাথ, ডা. ফরিদুল আলম, ডা. আব্দুল মজিদ সিকদার, ডা. সেলিনা আক্তার, ডা. বিজয় তালুকদার, ডা. মোহন দাশ, ডা. ইফতেখারুল ইসলাম, ডা. সন্দিপন রুদ্র, ডা. হিমেল আচার্য্য, ডা প্রসেনজিৎ মিত্র এবং স্টোর কিপার মহসিন কবির। করোনা কালে দুর্ভোগ দু:সময়ে এসব চিকিৎসকদের সেবা প্রদানে অপারগতায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে করে নুন্যতম চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছে না মানুষ। বাঁচার জন্য মানুষের আকুতি-আর্তনাদে ভারী হচ্ছে বাতাস। কিছু মানুষের করুন মৃত্যু মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবারে গত ১৭ মে নগরীর সুগন্ধার বাসায় ৮ সদস্য করোনা আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ২২ মে রাতে এস আলম পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও শিল্পপতি সাইফুল ইসলাম মাসুদের বড় ভাই মোরশেদুল আলম চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে মারা গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর সুবিধা না পেয়ে তার করুন মৃত্যু।

বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেও মেলেনি চিকিৎসা। সময় মত চিকিৎসা না পেয়ে গাড়িতেই মৃত্যুবরন করতে হয়েছে নগরীর বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শফিউল আলম ছগীরকে। টাকার দিকে তাকায়নি হাটহাজারীর একটি সংকটাপন্ন পরিবার। করোনার উপসর্গ নিয়ে গুরুতর অসুস্থ দুই ভাইকে বাঁচানোর জন্য পানির মতা টাকা ঢেলেছেন অক্সিজেন-ওষুধ ও হাসপাতালে। একটি আইসিইউ’র জন্য যত টাকা লাগে দিতে রাজি ছিল পরিবারটি। তবুও আইসিইউ মেলেনি। আইসিইউ’র অভাবে ৮ ঘন্টার ব্যবধানে করুন মৃত্যু হলো হাটহাজারীর বাসিন্দা দুই ভাইয়ের। এই দুই ভাই পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের পুর্ব দেওয়াননগর মরহুম গোলাম রসুলের ছেলে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী মো: শাহ আলম (৩৬) ও তার ছোট ভাই হাটহাজারী বাজারের এন জহুর মার্কেটের কাপড়ের দোকানের ব্যবসায়ী মো: শাহ জাহান (৩২)। গত ৫ জুন দুপুরে এবং রাতে তাদের করুন মৃত্যু হয়।

আর একটি ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। সাতদিন পর ছিল বাচ্চা ডেলিভারীর তারিখ। এর মধ্যেই উঠল প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। পেটে অনাগত সেই বাচ্চা নিয়ে মেয়েটি দিনভর ঘুরলেন হাসপাতালে-হাসপাতালে। টানা ১৮ ঘন্টা চেষ্টা করেও গোটা চট্টগ্রামে মেলেনি একটি আইসিইউ। শেষে অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই গভীর রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ১০ মাসের ওই গর্ভবতী নারী। মৃত্যুকালে ফৌজদারহাট কবরস্থানে মায়ের সঙ্গী হল ওই প্রথিবীর মুখ না দেখা বাচ্চাটাও। মায়ের পেটে সুস্থ থেকেও পৃথিবীর মুখটি আর দেখা হল না তার। গত ৯ জুন সকাল থেকে ৩০ বছর বয়সী ওই নারীর জন্য তার স্বজনরা চট্টগ্রামের এমন কোন হাসপাতাল বাদ রাখেননি আইসিইউ’র খোঁজে। সর্বশেষ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তা (৩০) নামের ওই নারী। অথচ এর ৮ দিন আগে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে প্রসুতি মায়েদের অগ্রাধিকার দিয়ে করোনা পরীক্ষা সহ সুচিকিৎসা দেওয়ার নিদ্র্শে দিয়েছিলেন বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। 

১৩ দিন আগে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে দেওয়া নমুনায় তার রিপোর্ট আসে করোনা পজিটিভ। স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবে তথ্য গোপন করে ওই ব্যক্তি চলে যান গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। মানুষের ভিড়ের মধ্যে প্রায় আট ঘন্টার এই যাত্রার পর সেখানে গিয়েও তিনি করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা কাউকে জানাননি। ৩৫ বছর বয়সী এই লোকটি চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। ১৩ জুন নোয়াখালী জেলা প্রশাসন করোনা পজিটিভ ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এরপরই তার বাড়ি লগডাউন করা হয়। এ ছাড়া প্রায় করোনা পজিটিভ হওয়া ৮৬ জনের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ভুল থাকায় তারা কে কোথায় আছে কেউ জানেন না। এসব রোগী নিজেরাই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বরাবরই স্বাস্থ্য বিভাগের খামখেয়ালী ও দায়সারা কর্মকান্ডকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার ও সচেতন নগরবাসী।

এরই মধ্যে গত ১৬ জুন মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে নগরীর শীর্ষ রেড জোন এলাকা ১০নং উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডকে লকডাউন করা হয়েছে। চসিকের কন্ট্রোল রুমে মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবিদা আজাদ, মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাশেম, নগর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মেয়র বলেছেন, বিসিক শিল্প এলাকা বাদে পুরো ওয়ার্ডে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না। যৌক্তিক কারন ছাড়া কেউ বের হতে পারবে না।

পুলিশ সদস্য, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক যারা এই ওয়ার্ডে বসবাস করেন তারা পরিচয়পত্র সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হতে পারবেন। জেলা প্রশাসনের তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী, পুলিশের টিম কঠোর নজরদারী করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলের মতে, ১০নং উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের সাগরিকায় অবস্থিত বিসিক শিল্প এলাকার ছোট বড় ১৫০ টি কারখানা লকডাউনের বাহিরে থাকায় তেমন একটা সুফল আসবে না। তাদের মতে ওয়ার্ড পর্যায়ে লকডাউন করে মানুষের বিচরন বন্ধ করা যাবে না। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অগ্রনী ভুমিকা রাখা বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে করোনামুক্ত করতে হলে গোটা চট্টগ্রাম নগরীকে বিভিন্ন জেলা থেকে অন্তত ১৫ দিনের জন্য সম্পুর্ন আলাদা করতে হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.