সমাপ্তির আগে ভেঙ্গে যাচ্ছে ৫৮ কোটি টাকায় নির্মাণাধীন সড়ক

0

চকরিয়া প্রতিনিধি,সিটি নিউজ : কক্সবাজারের চকরিয়ায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্বাবধানে ৫৭ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মানাধীন সড়কের কাজ সমাপ্তির আগেই ভেঙ্গে গর্ত হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সওজ বিভাগের গাফেলতির সুযোগে সড়ক নির্মান কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্টান নিম্নমানের নির্মাণ সমাগ্রী ব্যবহার করে, সীমাহীন দূর্নীতির আশ্রয় নেয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এ সড়কের নির্মাণে বরাদ্ধকৃত প্রায় ৬০ কোটি টাকার সমুদয় অর্থ ঠিকাদারের পকেটে যাবে। এতে হ-য-ব-র-ল ভাবে নির্মিত সড়কটি কোন উপকারে আসবেনা চকরিয়াবাসীর।

জানাগেছে কক্সবাজার সড়ক বিভাগের তত্বাবধানে ও চকরিয়া সওজের তদারকিতে চলতি অর্থবছরে ৫৭ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের শান্তিবাজার থেকে কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন হয়ে পার্বত্য লামা উপজেলার ইয়াংছা বাজার পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করে আরএবি আরসি প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ওই ঠিকাদরী প্রতিষ্টান কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নির্মাণ কাজ শুরু করেন।

কিন্তু ওই সড়কের নির্মান কাজের শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের রিরুদ্ধে। স্থানীয় জনসাধারণের পাশাপাশি প্রকল্পের দেখভালে নিয়োজিত সড়ক বিভাগের লোকজন খোদ এই অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।

অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি সড়কের উন্নয়ন কাজে কার্যাদেশ লঙ্ঘন করে নিম্নমানের সমাগ্রী ব্যবহার করায় বাঁধা দিতে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক হুমকি ধমকি খেয়েছেন সড়ক বিভাগের এক কর্মচারী। এ ঘটনায় চকরিয়া সড়ক উপ-বিভাগের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চরম ক্ষোভের পাশাপাশি উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। একইভাবে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় জনসাধারণও। এমন পরিস্থিতিতে ৫০ ভাগ কাজ শেষ না হলেও ঈদুল ফিতরের পূর্বে সওজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ২ কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন এবং নতুন করে আবারো বিল জমা দিয়েছেন।

আরো অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবীর চৌধুরী প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং সড়ক বিভাগের বেশ ক’জন সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে বুঝাপরার মাধ্যমে সড়কের নির্মাণ কাজে নিম্নমানের উপকরণ সামগ্রী ব্যবহার করছেন। সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাইড ওয়াল নির্মাণে আশ্রয় নেওয়া হয় চরম অনিয়মের। নিম্নমানের ইট, মাতামুহুরী নদীর কাঁদা বালু এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম সীমেন্ট ব্যবহারের ফলে গাইড ওয়াল নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণ ও সওজের স্থানীয় কর্মচারীরা কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগও করেন। কিন্তু কোন প্রতিকার তারা পায়নি। ফলে সওজ কর্মকর্তাদের আস্কারা পেয়ে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ কাজে স্থানীয়ভাবে দেখভালে নিয়োজিত সড়ক বিভাগের ছোট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবাদ করলেও ঠিকাদারের লোকজন কোন তোয়াক্কাই করছেনা। সড়কের যেসব স্থানে আরসিসি ঢালাই দেওয়ার কথা তাও কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে গতানুগতিক কার্পেটিং করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেসব স্থানে কালভার্ট (ব্রীজ) দেওয়ার কথা সেখানেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের সামগ্রী। ফলে নির্মাণাধীন ব্রীজের স্থায়ীত্ব নিয়েও সন্ধিহান রয়েছে।

বন্যা কবলিত এলাকা হওয়ায় সড়ক সম্প্রসারণ কাজে, বালি ও মাটি দিয়ে সড়ক উচুঁ করে টেকসই সড়ক নির্মাণের পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হলেও কাজের মান নিয়ে সওজ কর্মচারী ও স্থানীয়দের দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাজ করে কোন রকমে কাজ সমাপ্ত করার পরিকল্পনায় রয়েছেন। এছাড়াও সড়কে মাটি, বালু ও ইট সরবরাহে পৃথক পৃথক ঠিকাদার নিয়োগের নিয়ম থাকলেও মূল ঠিকাদার তা না করে নিজেরাই মাতামুহুরী নদীতে সেলু মিশিং বসিয়ে অনুমোদন বিহীন নিয়ম বর্হিভূতভাবে সড়কে ময়লা বালু ভরাট করছে। অন্যদিকে ঠিকাদার পরিবেশ আইন লঙ্গন করে সিডিউল না মেনে সুরাজপুর-মানিকপুর এবং ইয়াংছার পাহাড় কেটে সড়কে মাটি ভরাট করছে।

চকরিয়া সড়ক বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, নির্মানাধীন সড়কের গাইড ওয়াল, কালভার্ট ও সড়ক নির্মাাণকাজ সিডিউল বহির্ভূত কাজ করা হচ্ছে। নিম্নমানের ইট-বালি ব্যবহার করায় নির্মাণকাজে তদারকিতে নিয়োজিত সওজের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ বাঁধা দেয়ায় তাকে মারধরসহ প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এরপরও করোনা সংক্রমণের সুযোগে গোপনে নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টি জানতে পেরে চকরিয়া সওজের উপ-সহকারি প্রকৌশলীসহ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী সরেজমিনে গিয়ে গাইড ওয়াল নির্মানকাজে নিম্নমানের ইট ব্যবহার না করার জন্য বলে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ঘটনাটি কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে অবহিতও করেন। তিনি (নির্বাহী প্রকৌশলী) সম্প্রতি সরে জমিনে তদন্তে এসে এর সত্যতাও পান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, চকরিয়া সড়ক বিভাগের কিছু কর্মচারী পছন্দের ইটভাটা থেকে ইট কিনতে আমাকে চাপ প্রয়োগ করেন। হুমকির বিষয়টি অবান্তর।

কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু কুমার চাকমা বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক এবং আমার অফিসের লোকজনের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝির ঘটনা ঘটেছে এটি সত্য। কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত উভয়পক্ষ এ ধরনের বিবাদে জড়ালে নির্মাণ কাজের চরম ক্ষতি হবে। এতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে। তাই সবাইকে নিয়ে স্ব”ছতার মাধ্যমে কাজটি সমাপ্ত করতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি । সেখানে কোন ধরনের অনিয়ম হলে অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে চিরিংগা-বেতুয়াবাজার সড়ক মেরামত কাজেও বড় পুকুরচুরি প্রসঙ্গে তিনি বলছিলে শুধু মাত্র লিপিস্টিকের বরাদ্ধ এসেছিল।

এদিকে ১৭ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা ও সুরাজপুর-মানিকপুরসহ পাঁচটি ইউনিয়নের জায়গা পড়েছে। এসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণের আগে অর্থাৎ তিনমাস আগে পুরো সড়কটি একসঙ্গে খুলে ফেলার কারণে বর্তমান বর্ষাকালে কাদাযুক্ত সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এমনকি পায়ে হেটে যেতেও জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি নিম্নমানের কাজের কারণে বর্তমানে সমাপ্ত হওয়া কিছু এলাকায় কাজের অনেক অংশে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতে জনদুর্ভোগ আরো বাড়ছে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার ১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। সরকারের এত পরিমাণ টাকা নিম্নমানের কাজের মাধ্যমে পানিতে যাবে তা কোনভাবে মেনে নেয়া যাবে না। বিষয়টির আলোকে উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সভায় সিদ্বান্ত নেয়া হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উর্ধ্বতন প্রশাসনকে জানানো হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.