পুলিশের চেকপোস্ট বন্ধ!

অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণেও তৎপরতা নেই

0

নিজস্ব প্রতিনিধি,সিটি নিউজ : চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিভিন্ন থানার প্রবেশ মুখের চেকপোষ্টগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। সেখানে আগের মতো হচ্ছে না কোনো তল্লাশি কার্যক্রম। থানাগুলো অভিযান পরিচালনা, আসামী গ্রেপ্তার, মাদক, অস্ত্র, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা নেই। এভাবে নগর পুলিশের অভ্যন্তরে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে সুযোগ নিচ্ছে মাদক, অস্ত্র, চোরাচালানের কারবারীসহ বিভিন্ন দাগী অপরাধীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকলিয়া থানাধীন নতুন ব্রীজ মোড় সংলগ্ন চেকপোস্ট, কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জ্যারটেক পুলিশ বক্স, বায়েজিদ থানাধীন অক্সিজেন মোড়ের পুলিশ বক্স ও পাহাড়তলী থানাধীন সিটি গেইটে পুলিশ বক্সসহ নগরীর প্রবেশ মুখের যে কয়েকটি স্থায়ী চেকপোস্ট রয়েছে গতকালও তা রীতিমত বন্ধ দেখা গেছে। পুরো আগস্ট মাস জুড়ে সেসব চেকপোস্টগুলোতে পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিল না। আগস্টের আগে চেকপোস্টগুলোতে যেখানে নিয়মিত তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে।

শহরের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন থানা এলাকায় পুলিশের অস্থায়ী তল্লাশি কার্যক্রমও এখন চোখে পড়ছে না। নগরীর কোতোয়ালী, বাকলিয়া, বায়েজিদ, কর্ণফুলীসহ কয়েকটি থানায় প্রায় সময়ই নিয়মিত আসামী গ্রেপ্তার, মাদকদ্রব্য, চোরাচালানী পন্য উদ্ধারসহ মামলা দায়েরের ঘটনাও এখন তেমনটা নেই।

এসব থানার নিয়মিত মামলা গ্রহণ, তদন্ত, টহলসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যহত থাকলেও এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমগুলোর তৎপরতা পরিচালনা হচ্ছে না।

জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেছেন, পুলিশের রিকভারী সবসময়ই আপ-ডাউন করে থাকে। কখনো রিকভারী বেশি হয়ে থাকে, আবার কখনো কম হয়ে থাকছেঅ। আর পুলিশের দুটি চেকপোস্ট টেকনিক্যাল কারণে আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বিভিন্ন দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে সারা শহরেই পুলিশের চেকপোস্ট ও তল্লাশি কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন থানা এলাকায় হোটেল, আবাসিক ও বাসা-বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল।

অনেক সময় কৌশলগত কারণে এই ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে জানিয়ে সিএমপি কমিশনার বলেছেন, এখানে অন্য কোনো কারণ নেই।

তবে সম্প্রতি সময়ে পুলিশের নির্যাতনে এক কিশোরের আত্মহননের ঘটনা, সাদা পোশাকে অভিযান পরিচালনাকারী বিভিন্ন থানার কর্মকর্তাদের একযোগে বদলি ও সর্বশেষ সারাদেশে আলোচিত ওসি প্রদীপ কান্ডের ঘটনার পর পুলিশের মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওইসব ঘটনার পর বর্তমানে থানায় নিয়মিত মামলা গ্রহণ, তদন্তসহ নিয়মিত কার্যক্রমগুলো আগের মতোই স্বাভাবিক আছে। কিন্তু এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য দাগী সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অপরাধীদের গ্রেপ্তার, অস্ত্র, মাদক, চোরাচালানসহ বিভিন্ন উদ্ধার তৎপরতার যে ধরণের কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা হত বর্তমানে তা পরিচালনা হচ্ছে না। তবে এসবের বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতনদের কোনো নির্দেশনা নেই।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কার্যক্রম পরিচালনায় থানাগুলো একপ্রকার অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এসব কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে দুর্ঘটনা কিংবা ভুলবশত পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে সেটার দায়ভার এখন ঊর্ধ্বতনদের কেউই নিতে চাচ্ছেন না। অভিযান পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকেই পুরো দায়ভারই নিতে হবে। এতে এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সাহস ও মনোবল হারিয়ে ফেলছে মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ সদস্যরা। বড় ধরনের কোনো ঘটনা ছাড়া আগ বাড়িয়ে এখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন অভিযানে আগ্রহ দেখা”েছ না থানাগুলো। এসব নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে রয়েছেন থানার ওসিরাও।

সম্প্রতি সময়ের বিভিন্ন থানার এসআই ও এএসআইদের একযোগে গণবদলির বিষয়টিও নগর পুলিশের এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরির পেছনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সিএমপি উপ কমিশনার(পশ্চিম) ফারুক উল হক বলেন, এসবের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। এটা একটি সময় এসে ঠিক হয়ে যাবে।

জানা গেছে, পাঁচ মাস আগে শুরু হওয়া করোনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়মিত কার্যক্রমে সীমিত হয়ে আসে। পুলিশ সদস্যরা অভিযান ও উদ্ধার তৎপরতা কার্যক্রম বাদে বেশিরভাগ সময়ই ব্যস্ত ছিলেন করোনো ভাইরাস প্রতিরোধে। মহামারী ভাইরাস থেকে সাধারণ জানমালের রক্ষায় নগর পুলিশের বিভিন্ন উদ্যোগ, কর্মকান্ড ও আত্মত্যাগমূলক কর্মকান্ডে বাহিনীটির ভাবমূর্তি উজ্জল হয়ে উঠে। সাধারণদের কাছে প্রশংসিত হয়ে উঠে পুলিশ।

করোনো ভাইরাসের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে আসা শুরু করায় গত জুন-জুলাই থেকে নগর পুলিশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়মিত কার্যক্রম আবারো স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বিভিন্ন থানাগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, আসামী গ্রেপ্তার, অস্ত্র, মাদক, চোরাচালানসহ অবৈধ পণ্য উদ্ধার তৎপরতা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি ওসব ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। তবে গত জুলাইয়ে শেষ নাগাদ নগর পুলিশের বিভিন্ন থানার চিত্র পাল্টে যায়।

গত ১৬ জুলাই নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারুফ নামে এক কিশোরের আত্মহননের ঘটনায় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলালের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোটা অংকের টাকা দাবি ও পরে টাকা না পেয়ে ওই কিশোরকে ইয়াবা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠে। এছাড়া ওই কিশোরকে বাসায় না পেয়ে পরে তার মা-বোনকে থানায় এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরে ওই কিশোরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তৈরির পর পুলিশেরই একটি তদন্তে এসআই হেলালের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে তাকে বিভাগীয় মামলা প্রদানের পাশাাপশি বরখাস্ত করা হয়।

ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তবে ওই ঘটনার রেশ সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ওই ঘটনার পর সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমানের আদেশে নগরীর বিভিন্ন থানায় ১২ জন এসআইকে (উপপরিদর্শক) একযোগে বদলি করা হয়। গণযোগে ওই বদলির ক’দিন পর সিএমপি কমিশনারের আরেক আদেশে বিভিন্ন থানার অর্ধশত এএসআইকে গণহারে বদলি করা হয়। তবে ওই বদলি প্রক্রিয়াটি পুলিশের নিয়মিত বদলি কার্যক্রমের একটি অংশ হিসেবে সিএমপি’র পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাদের বদলি করা হয়েছে তারা মূলত বিভিন্ন থানার সিভিল টিমের সদস্য। সাদা পোশাকে অভিযান পরিচালনাকারী এসব সিভিল টিমের পুলিশ সদস্যরা যেমন চৌকস, তেমনি তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এতে পুলিশের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়।

ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আলোড়ন করার ঘটনা ঘটে টেকনাফ থানা পুলিশকে নিয়ে। সিএমপিতে দীর্ঘ সময় ধরে কর্মরত থাকা টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাসেদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি নিয়ে। ওই ঘটনায় নিহতের বোনের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রদীপ, লিয়াকত আলীসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে।

গুরুতর অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলার পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন, ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে আরও নতুন নতুন মামলা করছেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুরো বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। এতে আতঙ্কে রয়েছেন অন্যান্য অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা।

জে.এস / চট্টগ্রাম, সিটি নিউজ

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.