কে হচ্ছেন হেফাজতের আমির ! 

0

গোলাম শরীফ টিটু/ জুবায়ের সিদ্দিকীঃ হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা থেকে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহামদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে বহিস্কারের দাবীতে বিক্ষোভ করে মাদ্রাসার সাধারণ ছাত্ররা। একই সঙ্গে মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম আল্লামা আহম্মদ শফীকে মাজুর (অক্ষম) উল্লেখ করে কর্মক্ষম নতুন মুহতামিম নিয়োগ সহ ৫ দফা দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা।

গত বুধবার ১৬ সেপ্টেম্বর জোহরের নামাজের পর থেকে শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলন শুরু করে। জানা গেছে, আল্লামা আহম্মদ শফী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতার কারনে একাধিকবার তাকে দেশে বিদেশে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। নিজের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আল্লামা শফী দাপ্তরিক কাজে ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

এই সুযোগে মাওলানা আনাস মাদানী হেফাজতে ইসলাম ও হাটহাজারী মাদ্রাসায় নিজের বলয় বাড়াতে তৎপরতা শুরু করেন। মাওলানা আনাস মাদানীর প্রভাবে কোন কারন দর্শানো ছাড়াই কমপক্ষে ১১জন শিক্ষক-কর্মকর্তাকে বিনা কারনে মৌখিক নির্দেশে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগে আল্লামা আহম্মদ শফীর প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদকে কোন নোটিশ ছাড়াই দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

এর পর থেকেই আনাস মাদানীর প্রভাব, মাদ্রাসার ভেতরে প্রশাসনিক অনিয়মের বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায় হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি ইন্তেকাল করেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর খবর হাটহাজারী মাদ্রাসার মাইকে প্রচার করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। আল্লামা আহমদ শফির জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়াটিলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। তাঁর বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়াটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক। ছোট ছেলে আনাস মাদানি হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। আহমদ শফির শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এর পর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন।

১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান। সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন তিনি। এর পর টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি ওই পদে ছিলেন। ছাত্রদের বিভোক্ষের পর ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা কমিটির সভায় আহমদ শফি মহাপরিচালক পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর ছেলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালকের পদ থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আহমদ শফি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন।

২১ সেপ্টেম্বর বেলা দুইটায় হাটহাজারী মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে মাদ্রাসার ভেতর উত্তর মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। কয়েক লক্ষ মুসল্লি জনতা জানাজায় অংশগ্রহন করেন। অন্যদিকে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে অবস্থানের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসা হেফাজত ইসলাম এখন কার্যক্রমহীন। আবার হেফাজত কর্মীদের নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা ৮৩ মামলার কোন অগ্রগতিও নেই। সংগঠনটির আমির শাহ আহম্মদ শফীসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতা বিবৃতি দিয়ে মাঝে মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন। তবে সেই বিতর্কিত ১৩ দফা দাবীতে সক্রিয় অবস্থান নেই হেফাজত।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানী সহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হয়েছিল। আর হেফাজতের দাবি, শুধু শাপলা চত্বরেই নিহত হয়েছিল শতাধিক। এরপর বিভিন্ন সময় হেফাজত নিহতদের তালিকা প্রকাশের কথা বললেও দীর্ঘদিনেও তারা তা করেননি। ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন করা সহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে ঢাকা অবরোধ কর্মসুচী পালন করে আলোচনায় আসলেও এরপর এ দাবীতে মাঠে নামতে পারেনি কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলাম। বরং দিন দিন কার্যক্রম কমেছে সংগঠনটির।

বহুল আলোচিত অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ এখন নিস্ক্রিয়। কওমি মাদ্রসা ভিত্ত্বিক এই সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ার বিষষয়টি এসে গেছে প্রকাশ্যে। এর জের ধরে সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়লেও বিষয়টি নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কেউ মুখ খুলেননি। দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন আল্লামা শফী। তাঁর অনুপস্থিতিতে কে এই পদে আসীন হবেন, তা নিয়ে সংগঠনটিতে শুরু হয় জোর আলোচনা। এক পর্যায়ে আল্লামা শফী হেফাজতের নতুন আমীরের নাম প্রস্তাব করলেও শুরা সদস্যদের আপত্তির মুখে তা বাস্তবায়িত হয়নি।

মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে তাঁকে সরাতে তৎপর হয় একটি পক্ষ। হেফাজত স্ককীয়তা হারিয়েছে দাবী করে সংগঠনটির একটি অংশ বিকল্প হেফাজত গঠনে তৎপরতা চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে হেফাজতের মধ্যে চলা এই অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত ৭ জুলাই আল্লামা শফীর দেওয়া এক বিবৃতিতে। সেখানে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কোন দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। একটি চক্র হেফাজতকে বিরোধী দলের ভুমিকায় নিয়ে যেতে চায়। যা হেফাজতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারী গঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম। হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক ও কওমি মাদ্রাসা বোর্ড-বেফাকের সভাপতি আল্লামা শফী এর প্রতিষ্ঠাতা আমির।

সরকার প্রনীত শিক্ষানীতির বিরোধীতার মধ্য দিয়ে সংগঠনটি আত্বপ্রকাশ করলেও দেশজুড়ে আলোচনায় আসে ১৩ দফা দাবী নিয়ে। এই দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ ও মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে তারা পিছু হঁটতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনে হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি-জামাত সংশ্লিষ্টতা ও ইন্দন ছিল বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয় এবং অনেকে গ্রেপ্তার হন। এ অবস্থায় অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে সংগঠনটি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সংগঠনটির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়ে। কওমি মাদ্রাসার দাওয়ায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেয় সরকার। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেকানে শেখ হাসিনাকে কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি মাঠে তৎপরতা কমতে থাকে হেফাজতের।

শাপলা চত্বর ঘটনার প্রথম বছরপুর্তিতে ২০১৪ সালের ৫ মে হাটহাজারীতে দোয়া মাহফিল হয়েছিল। এর পর গত ছয় বছরে দিনটিতে কোন কর্মসুচী পালন করা হয়নি। বর্তমানে প্রতিবছর হেফাজত ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগরীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম লালদীঘির পাড়ে শানে রেসালাত সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এর বাইরে উল্লেখ করার মত কোন কর্মসুচী নেই তাঁদের। তবে ভবিষ্যত নেতৃত্ব নির্বাচন এবং সংয়ঠনে প্রভাব বিস্তার প্রশ্নে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব চলে আসছে অনেক দিন ধরে। একদিকে হেফাজতের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী সক্রিয় ভুমিকা পালন করছেন। এর বিপরীতে জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও হাটহাজারী উপজেলা হেফাজতের সাধারন সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী সহ কয়েকজন তৎপরতা চালাচ্ছেন।

জানা গেছে, গত ১৭ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মজলিসে শুরার বৈঠকে মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা শেখ আহামদকে হেফাজতের নতুন আমির হিসেবে ঘোষনা দিতে চেয়েছিলেন আল্লামা শফী। কিন্তু শুরা সদস্যরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। হেফাজতের আমির নির্বাচনের সঙ্গে হাটহাজারী মাদ্রাসার সম্পর্ক নেই জানিয়ে শুরা কমিটির সদস্যরা এই বিষয়ে সাংগঠনিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়ে দেন।

হেফাজত নেতাদের অনেকে মনে করেন, হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার নতুন প্রধান পরিচালক যিনি হবেন তিনিই পদাধিকার বলে হেফাজতের আমির হবেন। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে মজলিশে শুরা কমিটি হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসা পরিচালনায় তিন সদস্যের কমিটি ঘোষনা করেছে।

দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন, মাদ্রাসার প্রধান মুফতি আবদুস সালাম, বর্তমান সহকারী পরিচালক শেখ আহাম্মদ এবং মাওলানা ইয়াহিয়া। শুরা কমিটির সিদ্ধান্ত মতে, তিন সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি মাদ্রাসার সকল কাজের সুরাহা করবেন এবং ব্যংক সহ সকল হিসাবপত্র তাদের তিনজনের স্বাক্ষরেই হবে। সবারই সমান অধিকার থাকায় কেউ এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এতে করে হেফাজতের আমির কে হচ্ছেন এ প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে।

হেফাজতের নতুন আমির কিভাবে নির্বাচিত হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, মাদ্রাসার শুরা কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারন হেফাজতের গঠনতন্ত্র নেই। সাংগঠনিক কমিটির সভায় এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মতবিরোধ হবে।

এ ব্যাপারে হেফাজতে আমিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত হেফাজত ইসলামের যুগ্ন মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহি বলেছেন, হেফাজতের কার্যক্রম আগের মত রয়েছে। ১৩ দফা দাবির সব পুরন হয়নি। তাই দাবী আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন,’ হেফাজত কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। যেহেতু এটি ইমানি আন্দোলনের লক্ষ্যে গঠিত তাই যে সরকারই থাকুক না কেন হেফাজতের আন্দোলন বহাল থাকবে। তিনি আরও বলেন, ’একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী কওমিদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে’। হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় সাংগঠনিক তৎপরতা নেই কিন্তু ১৩ দফা দাবী বহাল রয়েছে’।

এদিকে আল্লামা শফীর মৃত্যুর কারনে একই সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং উচ্চতর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ’আল-হাইআতুল উলয়ালিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন আসছে। দেশের প্রবীন আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান ও কমিটিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.