বিএনপির রাজনীতি লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে

0

সিটি নিউজঃ বিএনপির এখন লেজে গোবরে অবস্থা। সরকার বিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বেফাস কথা বার্তা, দ্বিতীয় সারির নেতার প্রথমসারী নেতার ‍বিরুদ্ধে শো’কজ জারি, গঠনতান্ত্রিক কার্যকলাপে স্থবিরতা ও সাংগঠনিক নড়বড়ে হওয়ায় বৃহৎ একটি দল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা।

শীর্ষ নেতৃবৃন্দের হঠকারী সিদ্ধান্তে দলীয় ভিত্তি নড়েচড়ে উঠে প্রায়। নেতৃবর্গের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে আন্দোলনের রোডম্যাপ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। যার কারনে দলীয় নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও হঠকারিতার কারণে একই বৃত্তে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের অনুকম্পায় মুক্তি পেলেও শর্তের জালে বন্দি। দলীয় সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি ঘুরে দাঁড়াবে, এমন আশাও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিএনপির রাজনীতিতে কৌশলগত ও গুণগত পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবর্গ দলীয় ফোরামে বার বার গণতন্ত্রের কথা বললেও দলের অভ্যন্তরে তাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির দুর্বলতাই আওয়ামী লীগের অন্যতম শক্তি- সেটা বিএনপি উপলব্ধি করতে পারে না বলেই তারা লক্ষ্যহীন। তবে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটি যতদিন না একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হয়ে উঠবে, ততদিন দেশে গণতন্ত্রের সংকট দূর হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অবস্থান ফাঁকা আওয়াজের মতোই শোনাবে।

বিএনপিপন্থি রাজনৈতিক সমর্থক ডা. জাফরুল্লাহ মনে করেন, বিএনপির ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ কি সেটা খুঁজে বের করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। ঘুরে দাঁড়াতে হলে মুক্তিযুদ্ধ, ভ‚রাজনীতি এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে নীতি-কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া দুর্নীতিবিরোধী এবং সুশাসনের বিষয়ে জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে হবে। দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এক নীতিতে চলতে হবে।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আর দলে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। নাতনি জায়মাকে যদি তিনি প্রমোট করেন তার পাশে থেকে উপদেষ্টা হিসেবে পরামর্শ দিয়ে দলে পোক্ত অবস্থান তৈরি করে দিতে পারেন তাহলে সেই পারবে বিএনপির যোগ্য নেতৃত্বশীল হয়ে উঠতে। যেটা তারেক রহমানকে দিয়ে হবে না। তাছাড়া মুখে না বললেও বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতাই তাকে পছন্দ করেন না। তার কারণেই নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মির্জা ফখরুলকে মেনে নিতে পারেন না বলেই মাঝখানে রিজভী আহমেদকে ফখরুলের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে পারছে না বিএনপি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি ৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও ৫ বছরেও কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। গত ২ বছর ধরে তারেক রহমান সংগঠন গোছানোর দায়িত্ব নিলেও তা ঠিকমতো এগোচ্ছে না।

১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির বেশ কটি পদ অনেক দিন ধরে শূন্য আছে। অধিকাংশ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ছাত্রদল, যুবদল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ সব সহযোগী সংগঠন অগোছালো। কোনো কোনো কমিটিকে কেন্দ্র করে দলীয় অফিসের সামনে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে দলের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে- দিবস পালন, নেতাদের বক্তৃতা, রোজকার প্রেস ব্রিফিং ও প্রেস রিলিজের মধ্যে।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া গৃহবন্দি ও অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ এক যুগ বিদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। এই প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলছে। বিএনপি অতীতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তারেক রহমানের দেশে ফেরার আশা নেই বললেই চলে। এ কারণে তার নেতৃত্বে বিশ্বাস রাখতে পারেন না তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এছাড়া মুখে না বললেও তারেকের অনেক একক সিদ্ধান্তেই নাখোশ বিএনপির সিনিয়র নেতারা। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জামায়াতকে ২২টি আসনে মনোনয়ন দেয়া, দলের সাংসদদের সংসদে যোগ দেয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে পদবাণিজ্য, কমিটি গঠনসহ অনেক বিষয়ই তারেকের একক সিদ্ধান্তে ঘটে।

সূত্র জানায়, দলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জোর তৎপরতা শুরু করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ধীরেসুস্থে নিজের ঘনিষ্ঠদের বসাতে শুরু করেছেন। একদিকে গুলশানে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলছেন; অন্যদিকে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। সাংগঠনিক বেশির ভাগ কাজ করাচ্ছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভীকে দিয়ে। অঙ্গ সংগঠনের কমিটিগুলো প্রেস রিলিজের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে রাতের অন্ধকারে।

তারেক রহমানের নির্দেশে গত ১৪ ডিসেম্বর দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী দলীয় শৃঙ্খলার অভিযোগে শোকজ দেন দুই ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে। এ শোকজের বিষয়ে জানতেন না মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতা কেউই। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজকে শোকজ করায় সরকারি দলসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনায় দলটিতে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

সূত্র জানায়, তারেকের আশকারায় দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সংস্কারপন্থিরা আধিপত্য বিস্তারে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ‘হাওয়া ভবন’ সংশ্লিষ্টরাও বেশ তৎপর। এখন দলের প্রতি তারেক রহমানের সব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসে তৎকালীন হাওয়া ভবনের কুশলীবদের কাছে। দলে মহাসচিবের পদ দেয়া হলেও এক অর্থে সুতোয় ঘোরানো পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে মির্জা ফখরুলকে। মন রক্ষা করে মহাসচিবগিরি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই বেকায়দায় পড়তে হয় তাকে। বাধ্য হয়েই অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সায় দিতে গিয়ে নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। পদ ও নমিনেশন নিয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার প্রমাণও মিলেছে। এছাড়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যের বিরোধও আর লুকোছাপার বিষয় নয়।

এমন অবস্থায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতা। তারা ভাবছেন, দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তারেকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষৎ শেষ। তবে মনে কষ্ট থাকলেও বেশির ভাগ নেতা চুপ থাকেন। নেতারা জানান, তাদের রাজনীতি শেষ। দলে মূল্যায়ন নেই, মতামতের জায়গা নেই। বহুদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়েও তারা এখন দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

গত ৩১ অক্টোবর ঢাকা জেলা কৃষকদলের এক প্রতিনিধি সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া বিএনপি এখন সাংগঠনিকভাবে খণ্ড-বিখণ্ড। দলে কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। আমরা মাঠের আন্দোলনের চেয়ে ঘরোয়া ষড়যন্ত্রে বেশি ব্যস্ত। অভ্যন্তরের এসব খেলা বন্ধ না হলে সরকার হটানোর আন্দোলনে সফলতা আসবে না।

জানা গেছে, তারেকের প্রতি নেতাকর্মীদের অসন্তোষের বিষয় আঁচ করতে পেরেছেন খালেদা জিয়া। এজন্য আপাতত ভারমুক্ত করছেন না তারেক রহমানকে। নিজে চেয়ারপারসন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেই তারেককে দিয়ে দলের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করানোর ইচ্ছা তার।

খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বিএনপি আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু জামিন পেয়ে বাসায় ফিরে তিনি সম্পূর্ণ বিশ্রামে রয়েছেন। সরকারের দেয়া শর্ত তিনি ভঙ্গ করেননি। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, যেখানে দল আন্দোলন করে তার মুক্তির বিষয়ে কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারেনি; সেখানে শর্ত ভেঙে তার আবারো জেলে যাওয়ার কোনো মানে নেই।

জোট ও ফ্রন্ট নিয়েও বেকায়দায় রয়েছে বিএনপি। নির্বাচন কেন্দ্রিক জোট ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। উল্টো ঐক্যফ্রন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগে ২০ দলের নেতারাও দলের কর্মকাণ্ডে খুব একটা থাকেন না। খালেদা জিয়ার মুক্তির পর তার বাসায় দলের মহাসচিব, সিনিয়র নেতারাসহ ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতা দেখা করলেও ২০ দলের শরিক কোনো নেতা দেখা করতে পারেননি। এ নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে অনেকের।

জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই ২০ দলকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। ২০ দল আছে কি নেই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেটা খুবই বিব্রতকর। ২০ দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই মুহূর্তে জোটের শীর্ষ কয়েক নেতার দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটাই বন্ধুহীন বিএনপি। জামায়াতকে জোটে রাখার দায়ে গত নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়নি বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এছাড়াও বর্তমানে বড় ইস্যু চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী তাও স্পষ্ট নয়। ফরেন উইংয়ের অধিকাংশ সদস্যই নিষ্ক্রিয়। গত ৯ মাসেও বিশেষ কোনো বৈঠক করেনি এই উইং। জু-সি/ ২৭/১২/২০২০

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.