চসিক নির্বাচনঃ সহিংসতা ও রক্তাক্ত ভোট
রিপোর্টারের ডায়রী-৪
চসিক নির্বাচনঃ সহিংসতা ও রক্তাক্ত ভোট
জুবায়ের সিদ্দিকীঃ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচন নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল ভোটের দিন সেটিই সত্য হয়েছে। সারাদিন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত লেগে ছিল। এর মধ্যে গুলিতে নিহত হয়েছেন এক ব্যক্তি। পুলিশ বলেছিল, ভোটের দিন নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল, ভোট হবে নির্বিঘ্নে। কোন অনিয়ম হবেনা। বাস্তবে জনগণ দেখেছে, কিছুই হয়নি। ভোটের দিন আহত হয়েছেন নারী কাউন্সিলর প্রার্থীসহ অন্তত ৫ জন। বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, ককটেলের উৎসব। দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছে। সরকারী দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের দখলে ছিল প্রায় ভোট কেন্দ্র। অনেক ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় জনগণ বলেছেন, নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকেই ইভিএম সুরক্ষার প্রতি কেন্দ্রে একজন বা কয়েকজন বিজিবি, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে কেন্দ্রে প্রবেশ এবং বহিরাগত প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের দাবী জানালেও কমিশন আমলে নেয়নি। এমনকি গণমাধ্যম কর্মীদের সবাইকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে“সাংবাদিক পরিচয়পত্র” প্রদান করেনি। নির্বাচন কমিশনের ছিল ব্যর্থতা।
সকাল ১০ টার পর ভোটের কার্যক্রম চলাকালীন ভোটকেন্দ্রে গোপন বুথে সরকারদলীয় সমর্থরা কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে বুথের দখল নেয়। হামলা-পাল্টা হামলাসহ খুনের ঘটনায় উৎসরেব পরিবর্তে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে নগরীতে। সারাদিন সরেজমিনে কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেল, কেন্দ্রে বাইরে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর জটলা,কিন্তু কেন্দ্রের ভেতর ভোটারের দেখা নেই। ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রায় ওয়ার্ডের চিত্র ছিল একইরকম।
আমাদের সহকর্মীরা কেন্দ্র পরিদর্শন করে বলেছেন, মেয়র পদে কোন ঝামেলা নেই। মানুষ সুন্দরভাবে ভোট প্রদান করেছেন তবে সরকারদলীয় সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মরিয়া হয়ে গোলযোগ, কেন্দ্র দখল, পেশিশক্তির মহড়া পুলিশের সামনে হলেও পুলিশ ছিল নির্বিকার। এদিকে নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ট সচিব মো. আলমগীর বলেছেন, “ভালো নির্বাচন” হয়েছে।।
এক জরিপে দেখা গেছে, চসিক নির্বাচনে সর্বমোট ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিগত ২৭ বছরের ইতিহাসে ভোটের দিন এই প্রথম প্রাণহানি ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের সঙ্গে গোপন বুথে অবস্থান করে ভোট প্রয়োগে বাঁধা দেয়া কিংবা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না দেওয়ার ঘটনা ছিল প্রায় সব কেন্দ্রে। নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছন বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ। অবাক হতে হয়েছে। প্রায় কেন্দ্রে মেয়র পদে কোন ঝামেলা বা জবরদস্তি ভোটারের উপর ছিল না। সরকারদলীয় সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্যাডার ও লোকজনই ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ছিল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সরব। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসন কোন উদ্যোগ নেয়নি। খোদ আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতারা আক্ষেপ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কাউন্সিলর পদটিতে দলীয় সমর্থন দেওয়া উচিত হয়নি। এতে করে দলের মধ্যে বিভাজন, বিভক্তি ও কোন্দল, গ্রুপিং থেকে সংঘর্ষ, হানাহানি, খুনাখুনি ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। কাউন্সিলররা নয়, এতে করে দলের ভাবমুর্তি সাধারণ মানুষের কাছে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেভাবে দেশে ও সমাজে নষ্ট রাজনীতির ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে বলে জনগণ মনে করেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে ভোটের দিন একজন সহকর্মীকে নিয়ে যে কেন্দ্রে গিয়েছি সেখানে দেখেছি পেশিশক্তির মহড়া। পুলিশ প্রশানসনের নির্লিপ্ততা, যোগসাজস, কথিত নেতাদের বেহায়াপনা ও সাধারণ মানুষের ভোটদানে প্রতিবন্ধকতা। সাধারণ মানুষের অনেক প্রশ্নের জবার কি দেব ভেবে পাইনি। এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। নিজেও রাজনীতি করেছি। জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু দলের ভাবমুর্তিকে সবসময় সমুন্নত রেখেছি। এখন দলেন ভেতর হাইব্রীডদের দাপট ও কথিত মুরব্বী নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে শুধু ব্যক্তি স্বার্থের প্রয়োজনে দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে সাধারণ মানুষের কাছে। যে কারনে ক্ষোভ ও হতাশা হৃদয়ে ধারণ করছে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীগণ। নষ্ট রাজনীতি ও ব্যক্তি বিশেষের বেহায়পনা ও অবৈধ দাপট ঐতিহ্যবাহি আওয়ামী লীগকে ভাবমূর্তির শিখরে আঘাত যেন নিজের কাছেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে রক্তক্ষরণ করে।
সিটি নিউজ/জস